সংযমী আচরণ প্রত্যাশিত

একজনের বিশ্বাসে অন্যজন অবিশ্বাসীও হতে পারেন। কিন্তু একজনের বিশ্বাসে অন্যজন আঘাত করতে পারেন না। এ কথা দেশ-কাল-পাত্রভেদে সবার জন্যই সত্য। এ যেমন ধর্মক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও। অথচ আমাদের দেশে কখনো গণতন্ত্রের নামে, কখনো বা ধর্মের নামে অন্যের বিশ্বাসের ওপর আঘাত করাটা যেন কোনো ব্যাপারই নয়।


এই অনধিকার চর্চার মূল এক সূত্রে গাঁথা থাকলেও সময়ান্তরে তা বিভাজিত হয় বিভিন্ন কারণে। বলা যেতে পারে বৃক্ষের মতো। মূল একই, কিন্তু শাখা আছে অনেক। কেউ হয়তো ধর্মকে মানেন একভাবে, কেউ ভাবতে পারেন ভিন্নভাবেও। তাই বলে প্রভাব ও শক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে কেউ অন্যের বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেন না। ইসলাম ধর্মেও জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে কখনোই পরধর্মের ওপর আঘাত হানাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু হালে আমাদের দেশে ধর্মের নামে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহ্য না করার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক বিভাজন এবং তার জের ধরে শত্রুতা। এই বিভাজন মানুষকে ধর্মের প্রতি আস্থাশীল করে না, বরং বিরাগভাজন করে। তার পরও কিছু মানুষ সুযোগ পেলেই অহিতকর কাজটি করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
সম্প্রতি রাজবাড়ী শহরে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ২৮ জন বাউলের চুল ও গোঁফ কেটে দিয়েছে কিছু মানুষ। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের জোর করে মসজিদে ঢুকিয়ে তওবাও করানো হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জাকর এ কাজটি করেছে তারা ধর্মেরই নামে। এ দেশে বাউলদের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাউলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো খ্যাতিমান অনেকেই বাউলদের বিশেষ সমীহ করতেন। বাউলসম্রাট লালন শাহ শুধু বাংলায় নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত। বাউল দর্শন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি দর্শন। তাঁরা নিজেদের বিশ্বাস থেকে ধর্মকর্ম বা স্রষ্টাকে স্মরণ করেন। তাঁরা কোনো দিন কারো ধর্মকর্মে বাধা দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। তাঁরা মনে করেন, মানবধর্মই হচ্ছে ঈশ্বরকে পাওয়ার পথ। হিংসা-বিদ্বেষ তাঁদের আদর্শবিরোধী। এটাই বাউল মতবাদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নির্বিরোধ এসব বাউলের প্রতি যে আচরণ রাজবাড়ীতে করা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। যদি ওই বাউলরা ভুল পথে চলে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিচার করার মালিক তো একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ কি রাজবাড়ীর ওই লোকগুলোকে বাউলদের শাস্তি দেওয়ার কোনো এখতিয়ার দিয়েছেন?
আমরা আগেও দেখেছি, এ দেশে ইসলামের নাম করে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কাদিয়ানিদের মসজিদে হামলা চালিয়ে কোরআন শরিফের অমর্যাদা করা হয়েছে। অথচ সব মুসলমানের জন্যই একই কোরআন। চিহ্নিত এই মৌলবাদীরা সময়-সুযোগ পেলেই তাদের সাম্প্রদায়িক চেহারা উন্মোচন করে। প্রতিবারই তারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে। একবারও তারা চিন্তা করে না_ভিন্নমতাবলম্বী বলে কাউকে যদি আঘাত করা হয়, তাহলে সেও প্রত্যাঘাত করতে পারে। আর এতে অশান্তিরই সৃষ্টি হবে, যা শান্তির ধর্ম ইসলামের পরিপন্থী। আর গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ হিসেবে এবং দেশের সংবিধানও যেহেতু মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই আমাদের কারো ক্ষমতা নেই ভিন্নমতাবলম্বীদের এভাবে নির্যাতন করার। তার মানে হচ্ছে, ইসলামের নামে লালনভক্ত এসব বাউলের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তাতে লালনভক্ত সব মহলের ওপরই আঘাত হানা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি। পাশাপাশি এ ধরনের অসহনশীল পরিস্থিতির যেন এখানেই শেষ হয়_সেটাই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.