এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না by প্রভাষ আমিন

র‌্যাবের ক্রসফায়ার এবং বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমি দিনের পর দিন লিখেছি। তাতে পাঠকদের প্রশংসা পেয়েছি অনেক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্রসফায়ার চলেছে এবং চলছে বিরতিহীনভাবে। কোনো ধরনের জবাবদিহিতা, প্রশ্ন, আইন-কানুন, তদন্ত এবং বিচার ছাড়াই দিনের পর দিন এমন মানুষ খুনের উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও হয় না, হওয়া সম্ভব নয়।


একপর্যায়ে অনেকটা বিরক্ত হয়ে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমি আর কখনো ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে লিখব না। যে দেশে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট অবস্থান এবং হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও তা বন্ধ হয় না, সেখানে আমার মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সাংবাদিকের লেখা কেউ পাত্তা দেবে, এমনটা আমি আশাও করি না। ছোটবেলায় কাজের সংজ্ঞা পড়েছিলাম_সারাদিন পাথর ঠেলে যদি একটুও সরানো না যায়, তাহলে তা কোনো কাজ নয়। আমার লেখায় যদি কাজ না হয়, তাহলে দিনের পর দিন লিখে লাভ কী_এমন একটা ভাবনা পেয়ে বসেছিল আমাকে। কিন্তু আমাকে আবার কম্পিউটারের কি-বোর্ডে আঙুল ছোঁয়াতে বাধ্য করেছে লিমন। পত্র-পত্রিকায় তার ওপর র‌্যাবের নির্মমতার কথা পড়ে আর টেলিভিশনে নিরীহ-নিষ্পাপ চেহারার লিমনের কান্না দেখে আমার ভেতর তীব্র হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। তার কথা শুনে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কেঁদেছেন। আমিও কেঁদেছি। আমার বিশ্বাস, র‌্যাবের কয়েকজন পাথরপ্রাণ কর্মকর্তা ছাড়া বাংলাদেশের সব বিবেকবান, সংবেদনশীল মানুষ কেঁদেছে লিমনের কষ্টে। মনে হচ্ছে, কেউ শুনুক আর না-ই শুনুক, একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকাটা আমাদের সবার দায়িত্ব। অন্তত নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্য।
লিমন যেমন ছেলে, তাতে সংগ্রামী মেধাবী হিসেবে পত্রিকার সংবাদ হতে পারত সে। গরিব বাবা-মার সন্তান লিমনের লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ। এসএসসিতে জিপিএ ৪ পেয়েছে। ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করার পাশাপাশি পড়শোনা করতে হতো তাকে। এখন তার থাকার কথা ছিল পরীক্ষার হলে বা পড়ার টেবিলে। কিন্তু লিমনের এখন দিন কাটছে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, নিজের কাটা পা আর অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। পরীক্ষার হলে তার আসনটি ফাঁকা। বন্ধুরা খোঁজ নিচ্ছে, শিক্ষকরা খোঁজ নিচ্ছে। এলাকার মানুষ চাঁদা তুলে চিকিৎসার খরচ জোগাচ্ছে। লিমনের কী অপরাধ? লিমন তাদের গরু আনতে বাইরে বেরিয়েছিল। আর ব্যর্থ অভিযান শেষে ফিরছিল র‌্যাব। তারা এক সন্ত্রাসী ধরতে গিয়েছিল। না পেয়ে নিশ্চয়ই তারা খুব বিরক্ত ছিল। ফেরার পথে পেয়ে গেল ১৬ বছর বয়সী লিমনকে। এত বড় অভিযান, একটি গুলিও ফোটানো গেল না_র‌্যাবের মতো এলিট ফোর্সের প্রেস্টিজ থাকে নাকি! লিমনকে পেয়ে তাই তারা মেতে উঠল নৃশংসতায়। র‌্যাবের সদস্যরা ধরেই লিমনকে বলেছে, তুই সন্ত্রাসী। ব্যস, র‌্যাবের মনে হওয়া আর আল্লাহর ইচ্ছার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান এম সোহায়েল বলেছেন, 'আল্লাহর রহমতে সেদিন কেউ মারা যায়নি।' আহা, আল্লাহর রহমত ছিল বলেই অসীম দয়ালু র‌্যাব কর্মকর্তারা লিমনের পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করেছে; মাথায় বা বুকে করেনি। নিরীহ লিমনকে গুলি করার পর তা জায়েজ করার জন্য পুরনো খেলায় মেতে ওঠে র‌্যাব। তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগী বানানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে থানায় দুটি মামলা হয়েছে_একটি অস্ত্র মামলা, অপরটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা। ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড জায়েজ করার জন্য র‌্যাবের একটি সাজানো গল্প আছে। এ গল্পটি যিনি বানিয়েছেন, আর যা-ই হোক, গল্প লেখার মতো প্রতিভা তার নেই। কারণ, এমন গরুকে গাছে তোলা মার্কা হাস্যকর আষাঢ়ে গল্প কেউ বিশ্বাস করে না। যেকোনো ঘটনার পর র‌্যাবের একটাই ব্যাখ্যা_অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে বা আসামি ধরতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, তারাও পাল্টা গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই একজন গুলিবিদ্ধ হয়। কোনো গল্পই কেউ বিশ্বাস করে না। তবে লিমনের ক্ষেত্রে যে গল্প সাজানো হয়েছে, তা একটু বেশি হাস্যকর। পুলিশ বলেছে, তার বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলা ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটি নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি হওয়ায় র‌্যাবও একটি মামলা খুঁজে বের করেছে। কিন্তু আইনজীবী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, লিমনের চাচা জমিজমাসংক্রান্ত ঘটনায় তার বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কিন্তু সেই মামলায় লিমনের নাম নেই। র‌্যাবের ভাবটা এমন, যেন কাউকে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখাতে পারলে বা কারো নামে কয়েকটি মামলা দেখাতে পারলেই তাকে খুন করা বা পায়ে গুলি করা জায়েজ হয়ে যায়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, জমিজমাসংক্রান্ত একটি পারিবারিক বিরোধের মামলার আসামি লিমন, তাতেই কি তাকে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া যায়?
পত্রিকায় লিমনের ঘটনা পড়ে আমার ছেলে প্রসূণ আমিন আমাকে প্রশ্ন করেছে, বাবা, চাইলেই র‌্যাব বা পুলিশ কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে? আমি বললাম, পারে। তার এর পরের প্রশ্ন, মামলা প্রমাণ হওয়ার আগেই কি বিচার হতে পারে? আমি বললাম, না। বিস্মিত প্রসূণের পাল্টা প্রশ্ন, কিন্তু লিমনকে তো মামলার আগেই গুলি করে দিল? তার এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমি দিতে পারিনি। প্রসূণের এর পরের প্রশ্ন শুনে আমি থ বনে গেছি_'আচ্ছা বাবা, লিমনকে গুলি করে র‌্যাবের কী লাভ হলো?' আমি এই প্রশ্নটা ফরোয়ার্ড করতে চাই, র‌্যাবের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে।
কয়েক দিন আগে র‌্যাব ঘটা করে সপ্তম বর্ষপূর্তি পালন করেছে। এই সাত বছরে তাদের অনেক অর্জন আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে র‌্যাবের অবদান অনস্বীকার্য। এই লেখা পড়ে কেউ যেন ভাববেন না, আমি র‌্যাবের বিপক্ষে। আমি বিভিন্ন বাহিনীর চৌকস কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এলিট বাহিনী র‌্যাবের পক্ষে। আমি চাই চৌকস কর্মকর্তারা চৌকস কাজ করবেন। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবেন দক্ষতার সঙ্গে। হাতে অস্ত্র থাকলে কাউকে ধরে মেরে ফেলতে বা পঙ্গু করে দিতে কোনো দক্ষতা লাগে না। সাত বছরে অনেক সাফল্যের পাশাপাশি ক্রসফায়ারের নামে প্রায় ৭০০ মানুষ খুন করার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। এই ৭০০ পরিবারের অভিশাপ কি তাদের কালো পোশাককে আরো কলঙ্কিত করছে না। ক্রসফায়ারের জন্যও আমি র‌্যাবের কাউকে দায়ী করছি না। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া দিনের পর দিন এই খুনের মহোৎসব চলতে পারে না। সন্ত্রাসীদের খুন করে র‌্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করছে_এমন যুক্তিতে সরকার তাদের মানুষ খুন করার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে।
লিমনের ঘটনার পর আমার মনে হয়েছিল, এবার বোধ হয় র‌্যাব একটু বিপাকে পড়ল। নিশ্চয়ই তারা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু কোথায় কী, র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মিডিয়াবান্ধব কর্মকর্তা এম সোহায়েল ক্যামেরার সামনে অবলীলায় নির্জলা মিথ্যা বলে গেলেন। দেখে মনে হয়েছে, এমনভাবে মিথ্যা বলতে পারাটাই বোধ হয় তাদের চাকরির যোগ্যতা। আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো আরো এক ডিগ্রি ওপরে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খুব নির্বিকারভাবে বলে গেলেন, প্রয়োজনে এ ঘটনার তদন্ত হবে। আমি টেলিভিশনে তাঁর চেহারায় মানবিকতার ছাপ খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুব নির্বিকারভাবে তদন্ত হবে বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন তিনি। মন্ত্রী হলেই এমন পাথর হতে হবে!
র‌্যাব কি তাহলে আমাদের সবার বিবেককেই ভোঁতা করে দিচ্ছে? র‌্যাব নামের যে জগদ্দল পাথর আমাদের বিবেকের ওপর, আমাদের নিয়তির ওপর, আমাদের জীবনের হুমকি হয়ে চেপে বসে আছে, আমরা বিচ্ছিন্নভাবে কেউ হয়তো এ পাথর সরাতে পারব না, কিন্তু সবাই মিলে ধাক্কা দিলে পাথরও সরতে পারে। আমাদের আশা, হয়তো খুনি পরিচয় ঝেড়ে ফেলে র‌্যাব সত্যি সত্যিই একদিন অভিজাত বাহিনীতে পরিণত হবে।

লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.