মিডিয়া ভাবনা-সংসদ টিভি, একুশে ও গণমাধ্যম by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণ প্রচারের মধ্য দিয়ে ‘সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন’ (সংসদ টিভি) নামে একটি নতুন ও বিশেষায়িত টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়েছে। এক বছর ধরে এই চ্যানেল নিয়ে নানা কথা হচ্ছিল। এ রকম একটি টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।


সরকার মনে করেছে, এ রকম একটি টিভি চ্যানেলের দরকার আছে, তাই চ্যানেলটি চালু হয়েছে। চালু যখন হয়েই গেছে তখন আর এ নিয়ে সমালোচনা করে লাভ নেই। এখন সবাই মিলে আলোচনা করে দেখতে পারি, এই চ্যানেলের কার্যকারিতা বাড়ানো যায় কীভাবে।
সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, এই টিভি চ্যানেল সংসদ অধিবেশন সরাসরি সমপ্রচার করবে, যা এখন শুধু বাংলাদেশ বেতার করে থাকে। সরকার পরিচালিত বিটিভি জাতীয় সংসদের বিশেষ বিশেষ অধিবেশন সরাসরি সমপ্রচার করে। এখন সংসদ টিভি সংসদ অধিবেশন সরাসরি সমপ্রচার করবে। আর যখন সংসদ অধিবেশন থাকবে না তখন প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এ চ্যানেল চলবে। ওই সময় কী অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
যখন সংসদ টিভির পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন আমি এই কলামে সমালোচনা করে লিখেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশে এখন এর প্রয়োজন নেই। সংসদ অধিবেশনের প্রতিটি বাক্য যারা শুনতে আগ্রহী, তারা রেডিওতেই শুনতে পাচ্ছে। সংসদ অধিবেশনের প্রতিটি বাক্য সব মানুষের জন্য তেমন প্রয়োজনীয়ও নয়, তেমন আকর্ষণীয়ও নয়। বিশেষ বিশেষ অধিবেশন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বিটিভির মাধ্যমেও সমপ্রচার করা যেত। এ জন্য এত অর্থ ব্যয় করে একটি আলাদা টিভি চ্যানেলের খুব প্রয়োজন ছিল না।
অনেকে বলবেন, ভারতসহ অন্য বহু দেশে এ রকম সংসদ টিভি থাকলে আমাদের দেশে থাকবে না কেন? খুব সুন্দর যুক্তি। এর উত্তরে আমি একটি পুরোনো গল্প বলছি। এই গল্পের মধ্যে আমার উত্তরটা পাওয়া যাবে।
এরশাদ জামানায় এক বড় মন্ত্রী বিটিভির (তখন দেশে একমাত্র টিভি চ্যানেল) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে উপদেশের সুরে বলেছিলেন, ‘আপনারা বিবিসির মতো অনুষ্ঠান করতে পারেন না?’ বিটিভির কর্মকর্তা বিনয়ের সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয়কে বলেছিলেন, ‘খুব পারি, স্যার। আগে আমরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো পার্লামেন্ট করি, তারপর বিবিসির মতো অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে।’
আশা করি সচেতন পাঠক বুঝতে পেরেছেন, শুধু একটি প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করলেই হয় না।
সংসদ অধিবেশন সরাসরি সমপ্রচার করার ব্যবস্থাটি বোঝা গেল। এতে একটামাত্র লাভ হবে দেখতে পারছি। বিটিভি আর বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য ‘সম্পাদনা’ করতে পারবে না। সরাসরিই সমপ্রচার করতে হবে। অবশ্য ওই সময়ে ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ দেখা গেলে মান্যবর স্পিকার আর কী করতে পারেন।
যখন সংসদ অধিবেশন চলবে না তখন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কী প্রচারিত হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সংবাদপত্র সূত্র থেকে জানা গেছে, সংসদ অধিবেশন চলার সময় এই চ্যানেল থাকবে টেরিস্ট্রিয়াল, যখন অধিবেশন থাকবে না তখন (প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা) এটি হয়ে যাবে স্যাটেলাইট। এর মরতবা আমি বুঝতে পারিনি।
সংসদ টিভি চ্যানেল বর্তমান বিটিভির নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হচ্ছে। এটাও সংসদ টিভির একটি নেতিবাচক দিক। বিটিভি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, তারা ‘রাষ্ট্রীয় সমপ্রচার মাধ্যম’ নয়, তারা ‘ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের মাধ্যম’। বিটিভি খবর, টক শো, নানা পর্যালোচনা—সবকিছুই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত। বিটিভির খবর ও আলোচনা শুনলে মনে হয়, দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা রয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় সংসদের অস্তিত্ব বিটিভিতে নেই।
বিটিভির সঙ্গে সংসদ টিভিকে যুক্ত করে সংসদ সচিবালয় শুরুতেই এই টিভি চ্যানেলের বিশ্বাসযোগ্যতার মূলে আঘাত হেনেছে। এখনো বেশি সময় পার হয়নি। বিটিভির নিয়ন্ত্রণ থেকে সংসদ টিভিকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা নিলে ভালো হবে। না হলে বিটিভির মতো এই নবজাত চ্যানেলটিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সংসদ অধিবেশনের সরাসরি সমপ্রচার নিয়ে হয়তো তেমন সমস্যা হবে না। সমস্যা হবে বাকি দুই ঘণ্টায়। যখন সংসদ অধিবেশনে আলোচিত ইস্যু, অধিবেশনের নানা কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে তখন আশঙ্কা হয়, সংসদ টিভি বিটিভির মতো একপেশে দলীয় আচরণ করতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। বিটিভির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ তো সরকার বা ক্ষমতাসীন দলকে (সেটা বিএনপি, জামায়াতও হতে পারে) সেবা করা। গণতান্ত্রিক বা বহুদলীয় মতামত তুলে ধরা বিটিভির কর্মকর্তাদের মানসিকতায় বা প্রশিক্ষণে নেই। এখানেই হবে সমস্যা।
অনুমান করছি, কারিগরি সুবিধা লাভের জন্য সংসদ সচিবালয় বিটিভির শরণাপন্ন হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সহযোগিতার প্রয়োজন আছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজন নেই। সংসদ সচিবালয় নিজেরাই এই কারিগরি সুবিধা ক্রয় করতে পারে, যদি সরকার অনুমতি ও বাজেট দেয়। বলা বাহুল্য, তা দেবে। সংসদ টিভি পরিচালনার জন্য (প্রধান নির্বাহী, প্রশাসন, প্রযোজক, রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান ও অন্যান্য কর্মকর্তা) সংসদ সচিবালয় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সরাসরি নিয়োগদানের ব্যবস্থা করলে সবচেয়ে ভালো হয়। গণতন্ত্রমনা ও স্বাধীন চেতনার কর্মকর্তা ও কলাকুশলীরা এই টিভি চ্যানেলের জন্য উপযুক্ত হবে। মাননীয় স্পিকার যত শিগগির সম্ভব, বিটিভির নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাড়িয়ে স্বাধীন সংসদ টিভির ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দর্শকদের কাছে এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
সংসদ অধিবেশন বছরে মাত্র কয়েক মাস চলে। বাকি সময় এই চ্যানেল নিষ্ক্রিয় থাকবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তখন কিন্তু কর্মকর্তা ও কলাকুশলীদের বেতন দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য খরচও বহাল থাকবে। বাংলাদেশ কি এই অপচয় বহন করতে পারে? এ ধরনের অপচয়ের আশঙ্কা করেই আমি প্রায় এক বছর আগে এই কলামে লিখেছিলাম, এই চ্যানেল শিক্ষা বা উন্নয়ন চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। উন্নয়ন টিভির অংশ হিসেবে তিনটি সেক্টর আসতে পারত। ১) শিক্ষা, ২) উন্নয়ন, ৩) সংসদ ও গণতন্ত্রচর্চা। শুধু ‘শিক্ষা’ বা ‘উন্নয়ন’ নিয়ে পৃথক টিভি চ্যানেল করার সুযোগ আছে। যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের এত টাকা নেই, সেহেতু আপাতত একটি টিভি চ্যানেলেই শিক্ষা, উন্নয়ন ও সংসদ অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
যা হোক, এখন আর সেই সুযোগ আছে কি না জানি না। যদি না থাকে, তাহলে সংসদ টিভিকে কীভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে কাজে লাগানো যায়, তা বের করতে হবে।
সংসদ টিভির নাম পরিবর্তন করে যদি গণতন্ত্র টিভি করা হয়, তাহলে এর সীমানা অনেক বাড়িয়ে দেওয়া যায়। তখন এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, সংসদ অধিবেশন, প্রতিটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা নিয়ে অনুষ্ঠান, বিভিন্ন বিলের পরিচিতি, সংসদে উত্থাপিত বিল নিয়ে সংসদীয় বিতর্কের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মতামত, পাবলিক হিয়ারিং ইত্যাদি। গণতন্ত্র টিভি আরও একটি বড় কাজ করতে পারে, তা হলো আমাদের স্থানীয় সরকারগুলোর প্রতিটি স্তর নিয়ে পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন। জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নিয়ে পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারলে দেশের সর্বত্র এর প্রভাব সৃষ্টি হবে। বর্তমানে বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার (যারা নির্বাচিতও বটে) সম্পর্কে দেশের সরকারি, বেসরকারি কোনো মিডিয়ারই কোনো আগ্রহ নেই। এটা খুব অন্যায় কাজ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার, সাংসদ, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সম্পর্কে আমাদের মিডিয়ার যত উৎসাহ, স্থানীয় সরকার সম্পর্কে তার শতকরা ১০ ভাগও নেই। শুধু নির্বাচনের সময়ই মিডিয়া একটু তৎপর হয়। এই নীতির পরিবর্তন দরকার। গণতন্ত্র টিভি জাতীয় সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার সম্পর্কে সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠানমালা প্রচার করতে পারে।
গণতন্ত্র টিভির প্রস্তাবটি করতে হচ্ছে এ জন্য যে, শুধু সংসদীয় কার্যক্রম দিয়ে একটি টিভি চ্যানেল পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। জোর করে চালানো যায়, তবে তা দর্শকপ্রিয় হবে না। একটি সরকারি টিভি চ্যানেল চালু করার পর তা যদি বছরের অর্ধেক সময় বসিয়ে রাখা হয়, তা এক বিরাট অপচয় হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ সে রকম ধনী দেশ নয়। তাই এ ব্যাপারে সরকার, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, মাননীয় স্পিকার, সচেতন নাগরিক সমাজ—সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

একুশে ও গণমাধ্যম
ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা বিশেষ অনুষ্ঠান ও লেখা প্রকাশিত হবে। এসব অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রতিবছর ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণা একটু একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে না? স্মৃতিচারণা আর কত? এবার একটু বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলা ভাষার অবস্থান, সমস্যা ও নানা করণীয় সম্পর্কে বহুমুখী অনুষ্ঠান ও লেখালেখির আয়োজন করলে ভালো হয়। যে বাংলা ভাষা নিয়ে এত গান, এত প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে, কিশোর ও তরুণেরা সেই ভাষাটি কতটা শিখছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক সাক্ষর নাগরিক শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা লিখবেন ও বলবেন, এটা কি আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়? দেশের ৫০ শতাংশ মানুষকে নিরক্ষর বা শিক্ষাবঞ্চিত রেখে আমরা শুধু ভাষা আন্দোলন নিয়ে গর্ব করলে কি দায়িত্ব পালন হবে? দেশের সাক্ষরতা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমের উদ্বেগ কমই মনে হয়। শতকরা ১০০ ভাগ সাক্ষরতা অর্জনে সমস্যা কোথায়, সাক্ষরতা বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই, সাক্ষরতা অর্জনের জন্য যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তাদের নীতিমালা, কাজের পদ্ধতি, সাফল্য ও ব্যর্থতার একটা সালতামামি কি আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে করতে পারি না? বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বা এই সেক্টরে কী করছে, তা কি আমরা সবাই জানি? বিভিন্ন গণমাধ্যম এসব ইস্যু নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে মনোযোগী হলে একটা অর্থপূর্ণ কাজ হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.