গন্তব্য ঢাকা-সেই সব দিনের কথা by শর্মিলা সিনড্রেলা

কেউ যদি একটা চশমা বা সানগ্লাস হাতে নিয়ে দেখছেন, তো অন্যজন আরেকটা সানগ্লাস চোখে গলিয়ে আয়নায় দেখছেন কতটা মানাল। সেই সময়ই কেউ বা আবার দামটা মিটিয়ে দিচ্ছেন পছন্দের রোদচশমার। রোদচশমাগুলো বেশ আকর্ষণীয় বলে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে সব সময়।


আর দামটাও যে কমেই মেলে, তাই কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের চেয়ে এখানেই কিনতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এই ক্রেতারা। তাই তো হরদম রমরমা এই দোকান। কাকলী থেকে বনানীর দিকে যেতে কাকলী ওভারব্রিজের ডান দিকের ফুটপাতে রোজ সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার কাশালী ইউনিয়নের বামনগাতী গ্রামে বাড়ি তাঁদের।
কী নাম আপনার? প্রশ্ন করতেই বেশ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেন, ‘মিস্টার বাদল।’
জানতে চাই তাঁর জীবনের গল্প। বলতে শুরু করেন তিনি, ‘আমার অনেক পড়ার ইচ্ছে ছিল। আমি ছয়টা ভাষা জানি। পড়াশোনায়ও খারাপ ছিলাম না। বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি কিন্তু আমার বাবা জমির ধান কখনো বিক্রি করত না, তাই এইচএসসির পর টাকার জন্য আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।’
চাপা কষ্টটা যে তিনি বুকে বয়ে বেড়ান, তা বোঝা যাচ্ছিল তাঁর কথা থেকে। এই কষ্ট ভুলতেই হয়তো তিনি স্ত্রী তমাকে পড়াশোনার সুযোগটা করে দিয়েছেন। ‘ও এখন ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। আমাদের গ্রামেরই বঙ্গরত্ন ডিগ্রি কলেজে। তমা এখানেই থাকে আমার সাথে আর পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেয়।’
আপনার গ্রামের গল্প বলুন।
‘গ্রামের গল্প তো শুরু করলে শেষ করা যাবে না। আমি ছোট্ট বেলায় যে স্কুলটাতে পড়তাম, সেটার কথা খুব মনে পড়ে। সেই স্কুলটার আশপাশের এবং স্কুলটার জমিটুকুও আমাদের। এখন অবশ্য স্কুলটা সরকারি হয়েছে। ওই সব জমিতে যখন কলাই, সরিষা, পেঁয়াজ বা ধান লাগানো থাকে, তখন খুব ভালো লাগে। নিজেদের জমি থেকে ফসল তোলার আনন্দই অন্য রকম। সেই সব সবজির স্বাদও বেশি মনে হয়! আরও মজা হতো যখন আমরা বন্ধুরা একসঙ্গে খেলতাম। এখনো আমি বাড়িতে গেলে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলি। একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে পা কেটে গেল। আমি ছিলাম গোলকিপার। বল আসছে দেখে আমি ধরতে গেছি। তখন পড়ে গিয়ে শামুকে পা কেটে অনেক রক্ত ঝরেছে। সেলাইও করতে হয়েছিল ১৩টা। সেই সব দিনের কথা এখন খুব মনে পড়ে।’
বাবা নাগর বিশ্বাস আর মা উষা বিশ্বাস পথ চেয়ে থাকেন সব সময়। কাজের চাপের কারণে ছয় মাস পর পর বাড়িতে যাওয়া হয়। সপ্তাহে এক দিন কথা হয় ফোনে। কিন্তু মায়ের ব্যাকুল মন মানতে চায় না। তাই প্রায়ই কাঁদেন। তা ছাড়া তাঁদের ১৩ মাসের ছোট্ট নাতি নীরবও যে এই ঢাকাতেই থাকে। তাই ব্যাকুল যেন আরেকটু বেশিই হন। বাদলের স্ত্রী তমার বাড়ি পাশের গ্রামেই। তিন ভাই দুই বোন বাদলরা। বাবা আর ছোট ভাই সমীরণ পছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন তমাকে। গ্রামের কথা বলতেই বাদলের আরেকটি স্মৃতি মনে আসে, সেটি হলো, ‘গ্রামে একবার কলেরা রোগ এসেছিল। প্রায় দেড় শর মতো লোক মারা গেছিল, কিন্তু তবু আমরা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে যাইনি। ভাবতাম, যা হবে হোক, এই গ্রামেই থাকব। আমাদের কেউ তখন সেই রোগে মারা যায়নি, তবে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।’
১৪ বছর হলো ঢাকায় এসেছেন বাদল। যখন পড়াশোনায় ছেদ পড়ল, তখন বাদলের মনে হলো আয়ের পথ খুঁজতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই চাচাতো ভাই রঞ্জু শিকদারের সঙ্গে চলে এসেছিলেন ঢাকায় কিছু করার আশায়। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে বসেছেন চশমার ব্যবসা নিয়ে। ‘আগে গেঞ্জির ব্যবসা করতাম। পরে দেখলাম চশমার ব্যবসায় অনেক লাভ, তাই ওই ব্যবসা ছেড়ে এই ব্যবসা শুরু করলাম।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন কী, জানতে চাইলে বাদলের জবাব, ‘গ্রামে ভালো লাগে কিন্তু ওখানে আয় করার সুযোগ নাই। আর ঢাকায় অনেক আয় করতে পারি, তাই ঢাকা ছেড়ে যাওয়া হবে না। বড় দোকান নিলে প্রতি মাসে খরচ বাড়বে, আবার অগ্রিম যে টাকা দিতে হবে, সেটা দেওয়ার সামর্থ্যও আমার নেই। তাই এভাবেই ব্যবসা করে বাঁচতে চাই।’
গ্রামের কথা বলতে গেলেই বাদলের মনে ভেসে আসে ছোটবেলার দিনগুলো আর বন্ধুবান্ধবের মুখ। তাঁদের সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে থাকেন তিনি। ব্যাকুল হয়ে বলেন, ‘গ্রামে আমার অনেক বন্ধু ছিল। ওয়াসিম, শামীম, সাগর, ইলিয়াস—আমার অনেক ভালো বন্ধু। এখনো ওরা আমার সাথে দেখা করার জন্য এই ঢাকায় চলে আসে। গ্রামের সবার কথা খুব মনে হয়।’
আবার বন্ধুদের সঙ্গে বাদলের দেখা হবে, তবে ছয় মাস পর মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য।

No comments

Powered by Blogger.