ক্ষমতার নতুন খেলাড়ি by এম আবদুল হাফিজ

ক্ষমতার লড়াইয়ে পাকিস্তানে এক আনকোরা নতুন খেলাড়ির আবির্ভাব হয়েছে। এতদিন তা সর্বত্র সামরিক বাহিনী ও রাজনীতিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সে সীমানা ছাড়িয়ে তা সর্বত্র, এমনকি অশ্রুতপূর্ণ বিচার বিভাগকেও সংক্রমিত করেছে।


শোনা যাচ্ছে, এখন বিচার বিভাগ সামরিক বাহিনীর পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় আছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আদালত অবজ্ঞার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা পুনরারম্ভ ইস্যুতে এই প্রথম পাকিস্তানের ইতিহাসে একজন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আদালত অবজ্ঞার মামলা। এ ক্ষেত্রে আদালত তার বৈধ কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করছেন বলে অনেকের ধারণা। যে সুইস কর্তৃত্বের কাছে মামলাটি পুনরারম্ভ করার কথা তারাই নাকি মামলাটি ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করেছেন এবং তা এখন বন্ধ। মোশাররফ প্রবর্তিত ও ঘোষিত ঘধঃরড়হধষ ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ ড়ৎফরহধহপব (২০০৭)-এর আওতায় প্রেসিডেন্ট জারদারি এখন তার পূর্বের কৃত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বের যে কোনো স্থানে অব্যাহতি ভোগ করে। মজার কথা এই যে, উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং এ সাধারণ ক্ষমার ফায়দা উঠিয়েই স্বপদে পুনর্বহাল হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট এনআরওর মতো 'সর্বক্ষমা' নিয়ে প্রশ্ন তুলতে প্রধান ও অন্যান্য বিচারপতিকে নৈতিক কারণে পদত্যাগ করতে হয়। তা হবে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গের মতো হাস্যকর এবং কেউ মনে করে না যে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর পুনর্বহাল হওয়া বিচারকরা তা করবেন। প্রধানমন্ত্রী গিলানির নিয়োগপ্রাপ্ত আইতাজ আহমদ শুধু খ্যাতনামা আইনজ্ঞই নন, আইনজীবীদের মোশাররফবিরোধী আন্দোলনেরও তিনি একজন অগ্রদূত। উল্লেখ্য, এ আন্দোলনের ফলেই প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারকরা পুনর্নিয়োগ পেয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী গিলানি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়েছেন এবং তাকে সম্ভবত আর ব্যক্তিগতভাবে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে না; কিন্তু তার মামলা চলতেই থাকবে, যেমন চলতে থাকবে বহুল আলোচিত মেমোগেট মামলা। ক্ষমতার দরদালানে পাকিস্তানের সর্বশেষ বিতর্কের সূত্রপাত করে এই মেমোগেট ভুল বোঝাবুঝি, যা প্রকারান্তরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে এলেও বিচার বিভাগ এবং মিলিটারির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েই চলেছে।
পাকিস্তানি ঐতিহ্যে বিশেষ করে সিভিলিয়ান বনাম মিলিটারি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হঠাৎই কোনো স্ফুলিঙ্গের উৎপত্তি হলে এবং মিলিটারির জন্য একটি ফেইট একমপ্লি (ঋধরঃ ধপপড়সঢ়ষর) না হয়ে থাকলে পাকিস্তান কিন্তু এতদিনে মিটমাট করে ফেলারও পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলেছে। মেমোগেট বিতর্কের দীর্ঘসূত্রতাও অবাক হওয়ার কিছু। তবে সবাই নিশ্চিত যে, এই অনভিপ্রেত বিতর্কটিও নিশ্চিতভাবে থেমে যাবে। ক্ষমতার প্রধান খেলাড়িরা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক ধরনের নিষ্পত্তি করেই ফেলেছেন। সেনা বা সেনা গোয়েন্দাপ্রধান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে তারা এখন আর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলছেন না।
মনে হচ্ছে, সম্প্রতি উত্থিত বিতর্কের ধুলা এখন প্রায় থিতিয়ে এসেছে। পিপিপি বরং পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষকে জিতে নেওয়ার স্বপ্নেই এখন বিভোর। এ নির্বাচনকে সামনে রেখেই এখন পিপিপি নেতৃত্বের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যেভাবে প্রাদেশিক অ্যাসেমবি্লগুলোতে পিপিপির পক্ষে সমর্থনের পাল্লা ভারী হচ্ছে, এতে পিপিপি সিনেটকে তাদের কব্জায় আনার ব্যাপারে নিশ্চিত। পুরো পাকিস্তান এ মুহূর্তে যেভাবে নির্বাচনমুখী, তাতে আগাম নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে পারে। পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচন ২০১৩ সালেই হোক বা তার আগেই হোক, জারদারি নেতৃত্বাধীন সরকারই ভুট্টো-পরবর্তী প্রথম সরকার হবে, যা নাকি তার মেয়াদ পূর্ণ করতে সমর্থ হবে। যে দেশে এখনও গণতন্ত্রের শিকড়ই প্রোথিত হয়নি, সেখানে এটা কোনো সামান্য অর্জন নয়।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.