ইলিয়াস আলীর সন্ধান নেই-রহস্য বাড়ছে by মাসুদুল আলম তুষার ও রেজোয়ান বিশ্বাস

নিখোঁজ হওয়ার রাতে ইলিয়াস আলীর ঢাকার বাসভবন বনানীর 'সিলেট হাউসে' যাওয়া একটি জিপ গাড়ি ও এর আরোহীদের সন্ধান করছেন গোয়েন্দারা। ইলিয়াসের বাড়িতে ওই রাতে কোনো গ্রেপ্তার অভিযান চলেনি বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করলেও ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর হাইকোর্টে দাখিল করা রিট আবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।


র‌্যাব পরিচয়ে অন্য কেউ ওই রাতে ইলিয়াসের সন্ধান করলে তারা কারা- এ প্রশ্নের জবাবও মিলছে না। আবার ইলিয়াসের স্ত্রীসহ পরিবারের লোকজন বিষয়টি সম্পর্কে লুকোছাপা করছে- গোয়েন্দাদের এ দাবিতে রহস্য আরো বেড়ে যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার গোয়েন্দাদের একাধিক দল এ বিষয় যাচাই করতে ইলিয়াসের বাসভবন ও আশপাশে অনুসন্ধান চালিয়েছে।
এদিকে ইলিয়াস ও তাঁর গাড়িচালকের নিখোঁজ ঘটনা তদন্তে থানার পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ ও র‌্যাবের পৃথক দল কাজ করলেও গত রাত পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কারো কাছ থেকেই আশাব্যঞ্জক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব কারণকে সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে, এর কোনোটিরই প্রমাণযোগ্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ইলিয়াস আলীর পরিবার ও দলীয় সহকর্মীরাও কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা দিচ্ছেন না। বরং অনুমিত তথ্যে জোর দিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছেন তাঁরা।
ঘটনার রাতে ইলিয়াস আলী রূপসী বাংলা হোটেলে দলীয় লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে কী করেছেন, কখন তিনি হোটেল থেকে বের হন, সে সম্পর্কিত ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া ইলিয়াস ও তাঁর গাড়িচালকের মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কার কার সঙ্গে ও কী কী কথা হয়েছে, এর সব তথ্য জানতে পেরেছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। প্রকাশ্য রাস্তা থেকে অপহৃত হলেও এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী মিলছে না- সেটাও বিস্ময়কর।
গতকাল বিকেলে ঘটনাস্থল ও ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিবির তিন কর্মকর্তা। ইলিয়াস আলীর ছোট ছেলে লাবিব শারার জানায়, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ডিবির একটি দল এসে নিচতলায় ড্রয়িংরুমে তাদের সঙ্গে কথা বলে। তারা এখনো বাবার সন্ধান পায়নি বলে জানিয়েছে।
জিপ ঘিরে রহস্য : ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে হাইকোর্টে দাখিল করা রিট আবেদনে দাবি করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই ইলিয়াস আলীকে আটক করেছে। রিটে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, ১৭ এপ্রিল রাত পৌনে ১০টার দিকে ড্রাইভার আনসারসহ ইলিয়াস আলী বাসা থেকে বের হন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসায় অভিযান চালিয়ে তাঁর খোঁজ করে। এর পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরেকটি দল জিপে চড়ে ওয়্যারলেস হাতে তাঁর বাসায় আসে। তারা সেখানে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে চলে যায়। রিট আবেদনকারী এ খবর পরে পথচারীদের কাছ থেকে জানতে পারেন। ১৮ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে বনানী থানার এক পুলিশ সদস্য ফোনে রিট আবেদনকারীকে জানান, পুলিশ ওই গাড়িটি (যে গাড়িতে ইলিয়াস আলী ছিলেন) উদ্ধার করেছে। এ সময় রিট আবেদনকারী তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর স্বামী ইলিয়াস আলী সেখানে রয়েছেন কি না। জবাবে পুলিশ জানায়, ইলিয়াস আলী গাড়িতে নেই এবং গাড়িটি বনানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে পাওয়া গেছে। এর ড্রাইভারও গাড়িতে নেই। রিটে আরো বলা হয়, আটক ব্যক্তি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি সর্বদা দুর্নীতি ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। বর্তমান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অনেক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে তাঁকে অবৈধভাবে আটকের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি সব মামলায় জামিন লাভ করেছেন। রিট আবেদনকারী সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করেন যে রাত দেড়টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। আটকের ৩০ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়নি। তিনি কোথায় রয়েছেন সরকার সেটাও প্রকাশ করছে না।
রিট আবেদনের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতার কারণে তিনি কোনো কথা বলবেন না জানিয়ে বলেন, 'কোনো প্রয়োজন হলে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।' পরে লুনার বোন দিনা বলেন, ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে তাঁরা শুনেছেন এবং আইনজীবীর পরামর্শে তা রিটে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে আর কোনো বক্তব্য দিতে তাঁরা অপারগতা জানান।
কোনো সন্ধান নেই : ইলিয়াস আলীকে সরকার 'গুম' করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরাসরি বলেছেন, 'র‌্যাবের লোকেরা ইলিয়াসকে ধরে নিয়ে গেছে।' অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ঘটনা বিএনপির নাটক।' র‌্যাব ও পুলিশ জানিয়েছে, ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। ঘটনাটি নিয়ে তিন দিন ধরে সব গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক দল তদন্ত করছে। নিখোঁজ হওয়া নিয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও ইলিয়াস আলীকে 'উদ্ধার' সম্পর্কিত কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার লুৎফুল কবির বলেন, 'ইলিয়াস আলীর অবস্থান সম্পর্কে আমরা এখনো অবহিত নই। তাঁকে কে বা কারা কেন, কী কারণে ধরে নিয়ে গেছে বা কেন তিনি নিখোঁজ, এর সব কিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সংস্থার পক্ষ থেকে আলাদা টিম করে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।'
ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই রাতে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর খেঁfজ করা হয়। কিন্তু আশপাশের বিভিন্ন ভবনের নিরাপত্তারক্ষী ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি।
র‌্যাব ১-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। তদন্তে তাঁর ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, একান্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক বিষয়সহ অনেক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে সব কিছু যাচাই সময়সাপেক্ষ। নানা কৌশলে দ্রুত কিছু একটা করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি। ইতিমধ্যে ইলিয়াস আলীর ওই রাতে রূপসী বাংলা হোটেলে যাওয়া থেকে শুরু করে তিনি মোবাইল ফোনে কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন সে বিষয়গুলো জানা সম্ভব হয়েছে। তিনি রূপসী বাংলা হোটেল থেকে রাত ১২টার দিকে বের হন, এটাও জানা গেছে। ওই রাতে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। এর মধ্যে এক সাংবাদিকের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে তাঁর কথা হয়। এর আগে চালক আনসারের সঙ্গে মোবাইলে ইলিয়াসের কথা হয়।' তবে বনানীর বাড়ি থেকে গাড়িচালকসহ দুই ব্যক্তির সঙ্গে ইলিয়াস আলীর গাড়িতে ওঠার খবর সম্পর্কিত কোনো তথ্য নিশ্চিত হতে পারেননি র‌্যাব কর্মকর্তা।
র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, ইলিয়াস আলীর ফোন বন্ধ হওয়ার আগে মঙ্গলবার রাতে বাংলামোটর, ইস্কাটন ও রূপসী বাংলা হোটেল (শেরাটন) এলাকায় মোবাইল ফোনে তিনি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাত ১২টার পর সিলেটের এক সাংবাদিকের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তাঁর। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে কিছু লেখালেখি করা যায় কি না তা নিয়ে কথা হয় তাঁদের মধ্যে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, 'ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার আগে ওই রাতে রূপসী বাংলা হোটেলে অবস্থান করেছিলেন দলীয় ছয় ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁরা ছিলেন ইলিয়াস আলীর খুব কাছের লোক। মাঝেমধ্যেই ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তাঁরা ওই হোটেলে যেতেন। ওই রাতে ইলিয়াস আলী যেখানে বসে তাঁদের সঙ্গে যে কথা বলেন এর রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তে এমন অনেক তথ্য পাওয়া গেলেও ইলিয়াস আলীর সন্ধান পাওয়ার মতো কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি।'
প্রত্যক্ষদর্শী নেই : ব্যস্ততম রাস্তায় ঘটে যাওয়া কথিত অপহরণ ও গাড়ি দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশ তিন দিন অনুসন্ধান চালিয়ে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পায়নি। অনেকেই বলেছে, তারা ঘটনা সম্পর্কে শুনেছে বা ধারণা করছে। ঘটনার রাতে ইলিয়াস আলীর বাসার অদূরে নির্মাণাধীন নুরানী টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমানকে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচার পায়। গতকাল বিকেলে লুৎফর রহমান ওই রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, রাতে ভবনের বাইরের গেট বন্ধ করে তিনি ভেতরে একটি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ গভীর রাতে বিকট শব্দ শুনতে পান। তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর গভীর রাতে তাঁর আবারও ঘুম ভাঙে। তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চেয়ার থেকে উঠে বাথরুমে যান। বাথরুম থেকে ফিরে রাস্তায় শোরগোল শোনেন। ভেতরে দাঁড়িয়েই দেখতে পান, পুলিশের দুটি গাড়ি ও একটি প্রাইভেট কার। এ সময় আরো অনেকে ছিল সেখানে। রাতে কাউকে ধরে নেওয়া, ধস্তাধস্তি দেখেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে লুৎফর জানান, কোনো ধস্তাধস্তি তিনি দেখেননি। কেউ কাউকে ধরে নিয়ে গেছে কি না তাঁর জানা নেই। সকালে জানতে পারেন, একজন লোককে এই এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লুৎফর বলেন, 'র‌্যাব ও পুলিশ বিষয়টি নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমি এ বর্ণনাই জানিয়েছি।'

No comments

Powered by Blogger.