দ্রব্যমূল্য-সংবাদপত্রের কাছে প্রত্যাশা by প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ও মাহাবুবুর রহমান রাসেল

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র এবং গবেষক হিসেবে একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। কেজিপ্রতি এক বা দুই টাকা মূল্যবৃদ্ধি যেখানে আমাদের সংবাদপত্রগুলোর কাছে গরম খবর, সেখানে ১০-১২ টাকা মূল্যহ্রাস তাদের কাছে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবরই নয়! খুব কম পত্রিকাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছ
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ।


কিন্তু রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকাকে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া সাংবাদিকতা বিভাগের নবীন ছাত্রদের কাছে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় সাংবাদিকতার শিক্ষকদের। তারা প্রশ্ন করে, দর্পণে তো হুবহু প্রতিচ্ছবি দেখা যাওয়ার কথা; কিন্তু সংবাদপত্রে তো কখনও কখনও ঘটনা যা ঘটেছে তার উল্টো চিত্রও দেখা যায়! সাংবাদিকতা ক্লাসে ছাত্রদের প্রথমেই শেখানো হয়, মোটা দাগে সংবাদপত্রের কাজ হলো তথ্য প্রদান, শিক্ষাদান, বিনোদিত এবং প্রভাবিত করা। বাজার ও দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রেও কি সংবাদপত্র একইভাবে কাজ করে!
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ক্রমবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের প্রতিটি সংবাদপত্রই বর্তমানে বেশ তৎপর। প্রায় নিয়মিতই তারা বাজার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরে চাল, তেল, নুন, আটা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর, যা সরকার, নীতিনির্ধারক, মালিক শ্রেণী এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করে। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করেই সরকার এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে পারে, বাজার 'সিন্ডিকেটের' বিরুদ্ধে তৎপর হতে পারে। সংবাদপত্র তার এই 'ওয়াচডগ' (অতন্দ্র প্রহরীর) ভূমিকার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, খবরের কাগজের পাতায় আমরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর যতটা প্রত্যক্ষ করি, দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর কি তার সিকিভাগও দেখি? এটা ঠিক যে, দেশে যেভাবে অব্যাহতভাবে মূল্যস্টম্ফীতি বাড়ছে তাতে জিনিসপত্রের দাম একবার বেড়ে গেলে আবার কমার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। সেই অমানিশার মধ্যেও যখন দ্রব্যমূল্যের দাম মাঝে মধ্যে কমে যায় তখন সংবাদপত্র বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করবে, এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু 'ব্যাড নিউজ ইজ এ গুড নিউজ'_ সংবাদমূল্য নির্ধারণী এ তত্ত্বকে সামনে রেখে প্রায়ই দেখি দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর এড়িয়ে যায় সংবাদপত্রগুলো। আমাদের মূলধারার সংবাদপত্রগুলোও এ অভ্যাস থেকে মুক্ত নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম এক বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আগের চেয়ে যথেষ্ট কম ছিল। সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীকে আমরা দেখলাম দু'একদিন নিজেই বাজার মনিটরিংয়ে নেমে পড়লেন। তারপর আস্তে আস্তে আবার সবকিছু কেমন যেন আগের মতো হয়ে যেতে লাগল। দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বাড়তে থাকল। বাণিজ্যমন্ত্রীর চেহারাও তখন টিভির পর্দায় দুর্লভ হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন তা হলো দ্রব্যমূল্য। হওয়ার কথাও। ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিভি ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন, 'দ্রব্যমূল্য মানুষের প্রত্যাশার চেয়েও কম হবে।' কিন্তু পরে দেখা গেল মূল্য কিছুদিন কম থাকার পর মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটা বেড়ে গেছে। স্বভাবতই সংবাদপত্রসহ দেশের সব গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ল দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিজনিত সংবাদ। প্রায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রেই আমরা কিছু গৎবাঁধা শব্দ প্রত্যক্ষ করতে থাকলাম যেমন, 'দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উল্লল্ফম্ফন', 'দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া', 'অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি', 'অকার্যকর টিসিবি', 'সরকারের বাজার মনিটরিং নেই' ইত্যাদি। রোজকার দৈনিক পত্রিকায় দেখতে দেখতে শব্দগুলো মোটামুটি আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। কেউ আর ভাবতেই পারল না দ্রব্যমূল্য এ দেশে কমা সম্ভব। কিন্তু আশা ও আনন্দের কথা মাসখানেক আগ থেকে আমরা দ্রব্যমূল্যের কিছুটা হ্রাস লক্ষ্য করলাম। বিশেষ করে চালের দাম। যে কোনো প্রকার চালই কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকা কমে গেল। কেন কমল কিংবা এ কমার স্থায়িত্ব কতদিন সেটা অবশ্য আমাদের জানা নেই। সেই উত্তর অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা ভালো দিতে পারবেন।
কিন্তু যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র এবং গবেষক হিসেবে একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। কেজিপ্রতি এক বা দুই টাকা মূল্যবৃদ্ধি যেখানে আমাদের সংবাদপত্রগুলোর কাছে গরম খবর, সেখানে ১০-১২ টাকা মূল্যহ্রাস তাদের কাছে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবরই নয়! খুব কম পত্রিকাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। আমাদের জানা মতে, দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে এ নিয়ে একটিও কলাম লেখা হয়নি। অথচ বিষয়টির তাৎপর্য কতখানি সেটা বর্তমান নিবন্ধের প্রথম প্যারায় বর্ণিত গল্পটির দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে। চালের মূল্যহ্রাসের খবরটি না জানার কারণে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কেজিপ্রতি ১২ টাকা গচ্চা দিতে পারেন, সেখানে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথাটি একবার চিন্তা করুন। শুধু প্রচারের অভাবে চালের মূল্যহ্রাসের খবরটি জনসাধারণের আলোচ্যসূচিতে পরিণত হয়নি যতটা প্রচারের কারণে আলোচ্যসূচিতে পরিণত হয় মূল্যবৃদ্ধির খবর। ফলে জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আমাদের মনে উঁকি দেয়, তাহলে সংবাদপত্রের কাজ কী? শুধুই সরকারের সমালোচনা করা, নাকি স্বস্তির পরিবর্তে জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি করা! চালের মূল্য কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকা কমার পরও আমরা মনে করি তা এখনও এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে; কিন্তু তারপরও আমরা নিশ্চিত এ সংবাদ দেশের দরিদ্র জনসাধারণ তো বটেই এমনকি মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে একটি স্বস্তির সংবাদ। স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করেছিলাম এ খবরটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে সংবাদপত্র সরকারকে পরামর্শ দেবে কীভাবে এ ধারাকে অব্যাহত রাখা যায়, কীভাবে দ্রব্যমূল্যের লাগাম আরও টেনে ধরা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই চিত্র আমরা সংবাদপত্রের পাতায় দেখিনি। নাকি দর্পণের মতো সংবাদপত্রেরও ডান হাত হয়ে যায় বাঁ হাত, প্রতিফলিত হয় বাস্তবের উল্টো চিত্র?
আমরা মনে করি, সত্যিকারের দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের ভূমিকা কখনও এ রকম হতে পারে না। সমাজের আয়না হিসেবে সমাজে খুঁটিনাটি, ভালো-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন সংবাদপত্রের পাতায় তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। সংবাদপত্র যেমন সরকারের ভুল কাজের সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করবে, একই সঙ্গে সরকারের গঠনমূলক কাজের প্রশংসা করে সরকারকে উৎসাহিত করবে। জনগণকে সঠিক তথ্যটি প্রতিনিয়ত প্রদানের মাধ্যমে সংবাদপত্র তার চারটি প্রধান কাজের প্রথমটি যথাযথভাবে পালন করবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। মনে রাখতে হবে আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি যেখানে তথ্যকেই সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ জনগণ যে কোনো অন্যায়, অন্যায্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে। আর জনগণকে তথ্যসমৃদ্ধ করতে সংবাদপত্রের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। আশা করি ভবিষ্যতে নিজেদের দর্পণে সমাজের সঠিক চিত্রটি প্রতিফলিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্র তার অনন্য ভূমিকাকে আরও অনন্য করে তুলবে।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ও মাহাবুবুর রহমান রাসেল :শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.