সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজে তিন কোটি ঘুষ by অমিতোষ পাল

শতাধিক ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন ঢাকা ওয়াসার শীর্ষ দুই কর্মকর্তা। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের বদলি করে দেয়। ফলে এখন আর তাঁদের কাজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এর মধ্যে একজন আবার ঘুষের টাকা খরচ করে ফেলেছেন নিজের বাড়ি তৈরির কাজে।


আরেক কর্মকর্তা দু-একজনকে ফেরত দিতে পারলেও বাকিদের আর টাকা দিতে পারছেন না। এ নিয়ে দুই কর্মকর্তার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বচসা হচ্ছে ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের। 'স্যার' সম্বোধন এখন 'তুই-তোকারি'তে এসে ঠেকেছে। অশ্রাব্য গালিগালাজ (মুদ্রণযোগ্য নয়) করতেও দ্বিধা করছেন না পাওনাদাররা।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তাকসিম এ খান এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি আমার কানে আসার পরপরই তাঁদের (দুই কর্মকর্তা) বদলি করে দিয়েছি। কারো কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ না পেলে এর বেশি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব না।' অবশ্য এই বদলিকে তিনি সাধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের দাবি, কাজ দেওয়ার কথা বলে নয়, ধার হিসেবে তাঁরা টাকা নিয়েছিলেন। সেটাই এখন ফেরত দিচ্ছেন। কাউকে দিয়েছেন, কাউকে পরে দেবেন।
জানা গেছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা রোধে রাজধানীর খালগুলোর অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, খনন ও পাড় বাঁধাইয়ের জন্য সরকার আট কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৫০ লাখ টাকার কাজ করার প্রক্রিয়া শুরু করেন আলোচিত ওই দুই কর্মকর্তা ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইদুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন। পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) পদ্ধতিতে ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার আশ্বাস দেন তাঁরা। কাজ পাওয়ার আশ্বাসে ঠিকাদাররাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন। প্রতিটি প্যাকেজ কাজের জন্য তাঁরা দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা উৎকোচ দেন। এভাবে শতাধিক ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা আদায় করা হয়।
সাইদুল ইসলাম ও রুহুল আমিন ঠিকাদারদের টোপ দেন- প্রতি প্যাকেজে চার লাখ ৭০ হাজার থেকে চার লাখ ৯০ হাজার টাকার বিল হবে। ঠিকাদার এক লাখ টাকার কাজ করলেই চলবে। আমাদের আড়াই লাখ দেওয়ার পরও কম করে হলেও এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকা লাভ থাকবে। এই শর্তে দুই পক্ষে সমঝোতা হয়েছিল।
এরপরই ৫০টি উচ্ছেদ প্যাকেজ, ৭৮টি মাটি কাটার প্যাকেজ ও ৬০টি পাড় বাঁধাইয়ের প্যাকেজ তৈরি করা হয়। উপসহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সিরাজ উদ্দিন ও মাহবুব আলমকে দ্রুত ফাইল প্রসেস করতে বলা হয়। ততক্ষণে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে গত ১ এপ্রিল রুহুল আমিনকে ড্রেনেজ সার্কেল থেকে নারায়ণগঞ্জ জোনে এবং সাইদুল ইসলামকে একই কর্মস্থল থেকে প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়। বদলি হয়ে যাওয়ায় তাঁদের কাজ দেওয়ার ক্ষমতাও চলে যায়। এরপরই ঠিকাদাররা ওই দুজনের কাছে টাকা ফেরত চাইতে শুরু করেন। রুহুল আমিন দুয়েকজনকে টাকা ফেরত দিয়ে একপর্যায়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। আর সাইদুল ইসলাম বলেন, টাকাগুলো তিনি উত্তরায় বাড়ি বানানোর কাজে খরচ করে ফেলেছেন। তাঁকে কিছু সময় দিতে হবে। কিন্তু ঠিকাদাররা তাঁর এই আবদার মানতে রাজি হননি। প্রায় প্রতিদিনই তাঁরা সাইদুল ইসলামের কক্ষে গিয়ে টাকা ফেরত চাইছেন। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হয়ে রীতিমতো কেলেঙ্কারির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
ঢাকা ওয়াসার ঠিকাদার জানে আলম কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করেন, "আমি উচ্ছেদ প্যাকেজের একটি ও মাটিকাটা প্যাকেজের একটি কাজের জন্য সাইদুল ইসলামকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। বদলির পর ওই টাকা ফেরত চাইতে গেলে প্রথমে তিনি বলেন, 'পরে দেব। এখন বলছেন কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না। বাড়ির কাজে খরচ করে ফেলেছি।' সেদিন তাঁর রুমে গিয়ে ঝাড়ি দিয়ে এসেছি। এখন সাইদুল সন্ত্রাসীদের দিয়ে আমাকে ফোনে ভয় দেখাচ্ছেন। আমিও বলে দিয়েছি, ছাত্রলীগ নেতার টাকা মেরে খেতে পারবেন না।"
মো. শাহাবুল নামের আরেক ঠিকাদার বলেন, 'আমি আপাতত টাকাটা ফেরত চাইছি না। এটা আমার বিনিয়োগ হয়ে থাকল। ঘুরেফিরে একদিন ভালো জায়গায় পোস্টিং পেলে তখন তাঁর কাছ থেকে আরো বেশি কাজ আদায় করতে পারব।' তিনি বলেন, 'এখন সবাই তাঁর কাছে টাকা ফেরত চাইছেন। আর আমি বলেছি, আমারটা এখন ফেরত না দিলেও চলবে। এটা আমার ব্যবসায়িক পলিসি বলতে পারেন।'
সাদেক হোসেন ওরফে টাঙ্গাইল সাদেক নামের আরেক ঠিকাদার বলেন, 'কেবল আমার কাছ থেকেই না, ঢাকা ওয়াসায় এমন কোনো ঠিকাদার খুঁজে পাবেন না, যার কাছ থেকে কাজ দেওয়ার কথা বলে তাঁরা টাকা নেননি।'
ঠিকাদাররা জানান, ড্রেনেজ সার্কেলের এসব কাজে কোনোমতে খাল পরিষ্কার করে বা যৎসামান্য মাটি কেটেই বিল তুলে নেওয়া যায়। এ জন্য তাঁরা এসব কাজ পেতে বেশি আগ্রহী। জানে আলম, সাদেক ওরফে নোয়াখালী সাদেক, সাদেক ওরফে টাঙ্গাইল সাদেক, মোস্তাফিজুর রহমান, নীলু, আজিজ, প্রিন্স, টিটু, দেলোয়ার, মধু, মিন্টু, সাইফুর, ধলু, শামীম, সালাম, আখতারসহ অন্তত শতাধিক ঠিকাদার ওই দুই কর্মকর্তাকে টাকা দিয়েছেন। তাঁরা জানান, সাইদুল ইসলাম উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের ৩১ নম্বর হোল্ডিংয়ে একটি ১০তলা বাড়ি বানাচ্ছেন। এরইমধ্যে ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। ওই বাড়ির একটি তলায় সম্প্রতি তিনি বসবাসও শুরু করেছেন। বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে টাকাগুলো খরচ করে ফেলেছেন। কিছুদিন পর ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিলেও ঠিকাদাররা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ বিনা বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু ড্রেনেজ সার্কেলের কাজে দুর্নীতি হয় বলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে ওয়াসায় এটা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ বিধান মাথায় রেখে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ এমনভাবে বিভিন্ন প্যাকেজে ভাগ করে ফেলা হয়, যাতে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যেতেই না হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করানো হলে ঘুষ-বাণিজ্যে সুবিধা হবে না বলে ভাগ ভাগ করে এলটিএম পদ্ধতিতে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, এবার প্রকৃত প্যাকেজের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্যাকেজের বিপরীতে টাকা আদায় করা হয়েছে। যেমন পরিচ্ছন্ন কাজের ৫০টি প্যাকেজের বিপরীতে অন্তত ৮০টি প্যাকেজের টাকা নেওয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে মাটিকাটা ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজের ক্ষেত্রেও। একেকজন ঠিকাদার এক বা একাধিক প্যাকেজের জন্য দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন।
ঠিকাদার মোস্তাফিজুর রহমান নীলু অভিযোগ করেন, 'মাস দুয়েক আগে তিনটি কাজ পাওয়ার জন্য রুহুল আমিনকে এক লাখ ৯০ হাজার ও সাইদুল ইসলামকে চার লাখ টাকা দিয়েছি। বদলির পর টাকা ফেরত চাইলে তাঁরা ঘুরাতে থাকেন। কদিন আগে রুহুল আমিন ৯০ হাজার টাকার একটি চেক দিয়ে বলেন, বাকি টাকা কদিন পরে দেবেন। আর গত ১২ এপ্রিল সাইদুলের রুমে গেলে তিনি জানান আগামী ১৫ এপ্রিল এক চেকেই পুরো টাকা ফেরত দেবেন। সেই তারিখও পার হয়ে গেছে। এখন ফোনও ধরেন না। অফিসেও তাঁকে পাওয়া যায় না।'
ঘুষ নেওয়া প্রসঙ্গে রুহুল আমিন বলেন, 'আমি কাজ দেওয়ার কথা বলে কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি। মোস্তাফিজুর রহমানকে যে টাকা ফেরত দিয়েছি, সেটা তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। যদি কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকি, সেটা বন্ধুত্বের খাতিরে, কাজ দেওয়ার কথা বলে নয়।'
তাহলে আপনাকে বদলি করা হলো কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'আমার তো ড্রেনেজ সার্কেলে চাকরির মেয়াদ তিন বছর হয়ে গেছে। আর সাইদুল সাহেবের হয়তো অভিজ্ঞতা কম। এ জন্য তিন-চার মাসের মাথায়ই তাঁকে বদলি করে দিয়েছে।'
সাইদুল ইসলাম টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, 'আমার রুমে এসে যে ঠিকাদাররা চিল্লাপাল্লা করেছে, তার কাছ থেকে আমি কোনো টাকা নেইনি। তারপরও সেদিন একজন আমাকে বলেছে, আমি নাকি টাকা নিয়েছি। পরে ছাত্রলীগ করা দুজন ঠিকাদার টুলু ও শিশির এসে আমাকে বলে গেছে, স্যার আমরাও বিশ্বাস করি না যে আপনি টাকা নিতে পারেন। যারা কাজ পায়নি তারাই আমার নামে এসব কথা ছড়াচ্ছে।'
মাত্র চার মাসের ব্যবধানে বদলি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সেটা আমি জানি না।'
ঘুষের টাকায় উত্তরায় বাড়ি বানানো প্রসঙ্গে সাইদুল ইসলাম বলেন, 'এটা আমার একার নয়। সঙ্গে ডেভেলপার আছে।'
তবে সাইদুল ইসলামের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জানান, বাড়ি বানানোর কাজে প্রথমে একজনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি নিজেই পুরোটা তৈরি করছেন।

No comments

Powered by Blogger.