একালের সফদার ডাক্তার by ফজলুল হালিম রানা

মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা আর লখিন্দরের কাহিনী শোনেনি এমন বাঙালি নেই বললেই চলে। চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করতে অস্বীকৃতি জানালে মনসা সাপ পাঠিয়ে চাঁদ সওদাগরের ছেলে লখিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে সাপের দংশনে নিহত হলে সৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে মৃতদেহ ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো এ আশায়, ব্যক্তিটি হয়তো অলৌকিকভাবে ফিরে আসবে।


বেহুলা সবার বাধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সঙ্গে ভেলায় চড়ে বসে। তাদের এ যাত্রা ছয় মাস ধরে চলে। এ অবস্থায় মৃতদেহ পচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসী তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে। একসময় ভেলাটি মনসার পালক মাতার কাছে আসে। তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। তিনি মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পেঁৗছে দেন। মনসা বলে, তুমি তাকে (লখিন্দরকে) ফিরে পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু এটি কেবলই সম্ভব হবে যদি তুমি তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারি করতে পার। 'আমি পারব', বেহুলা জবাব দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে। এই পৌরাণিক পর্বে ওঝারূপে মনসা মৃত লখিন্দরকে তার দৈব চিকিৎসার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তোলে! সেই দৈব চিকিৎসার চর্চা আমাদের দেশে এখনও চলছে। তবে এখন আর পৌরাণিক রূপে নয়, বাস্তবে। এখনও এ যুগে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি, দেশের আনাচে-কানাচে কিছু দৈব পীরবাবা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। শুধু তাই নয়, হাতিয়ে নিচ্ছে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ। এর সর্বশেষ সংস্করণ আঁতকে ওঠার মতো। খবরটি প্রকাশিত হয় গত ১৪ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে 'ক্যান্সারের চিকিৎসার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের প্রতারণা' শিরোনামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! তার দাবি, তিনি আধ্যাত্মিকভাবে ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন। তিনি পীর বংশের সন্তান। তার মৃত চাচা স্বপ্নে এ চিকিৎসা তাকে শিখিয়েছেন। এ না হলে শিক্ষক! শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি পরিবার থেকে প্রচুর অর্থ, কোনো কোনো পরিবার থেকে ১৫ লক্ষাধিক টাকা। কেউ কেউ এ জন্য জমি বিক্রি করেছে, কেউ বা রেখেছে বাড়ি বন্ধক। পরিবারগুলোর কথা আর কী বলব; বেঁচে থাকার আকুতি সব মানুষের সব যুগে সব কালে। আর এ দেশের এই কথিত চিকিৎসকরা তখন এ মানুষগুলোর সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা করে অর্থের জন্য। চিকিৎসক সেজে একটা মানুষকে তারা মেরে ফেলে টাকার জন্য। ডাকাত আর এদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এবার আসা যাক হোসনে আরার সফদার ডাক্তারদের কাছে। ছোটবেলায় হয়তো অনেকেই পড়েছেন হোসনে আরার ছড়া_ 'সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে'। কয়েকদিন আগে পত্র-পত্রিকায় ওহাব ডাক্তারের কাণ্ড ছাপা হয়, ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে যে জয়নুল হক শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরি বাগিয়ে নেয়। সে একজন ওষুধ বিক্রেতা! এ ছাড়া গত ১৪ জুলাই দৈনিক 'আমাদের সময়ে' আরেক ডাক্তারের খবর ছাপা হয়, যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। সেও ওহাব ডাক্তারের মতো ডাক্তার পরিচয় দিয়ে রোগী দেখে বেড়াচ্ছে। এরা সফদার ডাক্তার নয়তো কী? আর এ রকম সফদার ডাক্তার, উপরোলি্লখিত দৈব ডাক্তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশের সর্বত্র। এদের কাছ থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মেহনতি মানুষ মুক্তি চায়। মানুষের অন্তিম মুহূর্তে জীবন নিয়ে যারা খেলে এসব প্রতারকের কাছ থেকে বাঁচতে চাই আমরা। রাষ্ট্রের কাছে সুচিকিৎসা পাওয়া আমাদের নাগরিক অধিকার। রাষ্ট্র সেটি নিশ্চিত করতে না পারলেও এ প্রতারক চক্রকে প্রতিহত করার দায় এড়াতে পারে না।
 

No comments

Powered by Blogger.