এ উপবাস ভারতের জীবন রক্ষার জন্য by এম জে আকবর

মহাত্মা গান্ধী নিজেকে ১৭ বার উপোষ করে কষ্ট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সবই আমরণ অনশন ছিল না। এর মধ্যে কিছু উদ্দেশ্য ও লক্ষপূর্ণ অনশনও ছিল। কিন্তু এর সবই তাঁর জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ২১ দিন পর্যন্ত লাগাতার আহার বা চিকিৎসা গ্রহণ না করে ৫০ কেজির কাছাকাছি কৃশকায় মানুষটি মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন।


গান্ধী দূরদ্রষ্টা ছিলেন। তাই কখনো ভুল দ্বারা তাড়িত হননি। গান্ধী কখনো এ কথা বিশ্বাস করতেন না যে, একটি উপবাস করলেই ব্রিটিশরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে মাথার মুকুট খুলে, লাভের হিসাব ফেলে রেখে এই বিশাল সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে রাজি হবে।
ব্রিটিশের প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদাই গান্ধীকে উপেক্ষা করতে চেষ্টা করত (শুধু লর্ড এরউইন ছিলেন ব্যতিক্রম)। কিন্তু ১৯৪০ সালের পরের বছরগুলোতে যখন পরাজয়ের ছায়া ঘনিয়ে আসে তখন তাদের সে মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। কারণ অহিংসার অসাধারণ অস্ত্র, নৈতিক বল এবং অভূতপূর্ব রাষ্ট্র জাগরণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজ্যকে শিথিল করে দেয় এবং সে সাম্রাজ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। গান্ধী যখন তাঁর আন্দোলন শুরু করেন তখন উচ্চ শিখরে বসে লর্ড সিনহা (সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিনহা, ১৯২০ সালে বিহার এবং উড়িষ্যার গভর্নর এবং প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন-অনুবাদক) বিশ্বাস করতেন যে, ব্রিটিশের শাসন অন্তত ৪০০ বছর পর্যন্ত কায়েম থাকবে। এ ঘটনার ৩০ বছর পর ভারতের ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা শেষ ভাইস রয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ সালে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন : তিনি (গান্ধী) বহু চালাক, জেদি, দুমুখো এবং একনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ। এমন মিথ্যাচার শুনে আপনি হয়তো তাঁকে ঘৃণাই করবেন। কিন্তু এরপর তিনি লিখেছেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় ব্রিটিশরাজ এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে বাংলায় ৪০ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করে। এটাই একটি প্যারাডঙ্ যে বহু ইংরেজ, যাঁরা তাঁর স্বপ্নকে খতম করতে চাইতেন, তাঁরা তলে তলে গান্ধীর প্রশংসাকারী ছিলেন। তাঁরা এ কথা অনুভব করতেন যে, যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে তাঁদেরও গান্ধীর সঙ্গেই থাকতে হতো। গান্ধীজী পুনে কারাগারে থাকতে ১১ জানুয়ারি তাঁকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের জন্য সেসন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১২ জানুয়ারি রাতে সার্জন-জেনারেল কর্নেল মেডক দুজন ইংরেজ নার্সের সহায়তায় যখন অপারেশন করেন তখন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন তিনি টর্চ জ্বালিয়ে অপারেশনের কাজ সম্পন্ন করেন। গান্ধী তাঁর প্রাণরক্ষার জন্য তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং তাঁরাও গর্বিত হন। গান্ধীর সামনে ইংরেজরা রেখেছিল অর্ধেক চ্যালেঞ্জ, বাকিটা রেখেছিল ভারতীয়রাই।
গান্ধী ভালো করেই জানতেন যে, হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রয়েছে তাকে অন্তত প্রশমন না করা গেলে সব লক্ষ ও উদ্দেশ্য অর্থহীন হয়ে যাবে। এই ভারতীয় জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তাঁর কাছে কোনো হাতিয়ার ছিল না, কিন্তু তিনি একটি গোপন অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ভারতীয়দের নৈতিকতাকে ব্লাকমেইল করতেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি অনশনের মাধ্যমে নিজের জীবন বাজি রাখতেন। কারণ ভারতীয়রা গান্ধীর জীবন বাঁচাতে যেকোনো কিছু করবে। আর এভাবেই ভারতীয়রা বারবার গান্ধীর জীবন রক্ষায় মূল্য দিয়েছে। কারণ হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, কেউ মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পাপ নিজের ঘাড়ে নিতে রাজি ছিলেন না।
এমন যে কারো উপবাসের ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া হতাশায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। সরকারকে ঝাঁকি দেওয়ার জন্য কোনো অনশনই সফল হয় না। এ অনশন বরং জনগণের মধ্যে একটি চেতনা তৈরি করে থাকে। দিলি্লতে আন্ন হাজারির অনশনের উদ্দেশ্যও সরকারকে দুর্বল করা নয়, বরং তাঁর উদ্দেশ্য (অন্তত তাই হওয়া উচিত) সেসব মানুষকে জাগানোম, যারা এ দেশের নেতাদের এবং তাঁদের অনুসারীদের লুণ্ঠন করা দেখেও অকর্মণ্য হয়ে বসে আছে। আন্না হাজারি এটা দেখার জন্য প্রতীক্ষা করেননি যে কতজন মন্ত্রী তাঁকে দেখতে আসবেন কিংবা তাঁকে অনশন ভাঙাবেন। বরং আন্না দেখতে চেয়েছেন অলি-গলিতে নিজের ঘরের সামনে কতজন ভারতীয় আন্না হাজারির মতো প্রতিবাদ শুরু করতে পেরেছেন। তিনি একটিই প্রশ্ন করেছেন; হিন্দুস্তান, তোমার সঙ্গে কি বিবেক নেই?
যদি জবাব হয় হ্যাঁ আছে, তাহলে জেগে ওঠো, তোমার ভারতকে ভ্রষ্টাচারের হাত থেকে রক্ষা করো।

লেখক : দি সানডে গার্ডিয়ানের সম্পাদক এবং ইনডিয়া টুডের এডিটরিয়াল ডিরেক্টর।
ভারতের ভাস্কর পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ।
হিন্দি থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.