গুন্টার গ্রাস : সহজ কথা যায় না বলা সহজে by গাজীউল হাসান খান

অশীতিপর জার্মান কবি ও লেখক গুন্টার গ্রাসকে তাঁর একটি সাম্প্রতিক কবিতার জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্রের নেতারা 'ইহুদিবিদ্বেষী' বলে অভিযুক্ত করেছেন। নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়স্ক এ সাহিত্যিকের অপরাধ তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত রচনা, 'যে কথা বলতেই হবে', কবিতায় ইসরায়েল রাষ্ট্র সম্পর্কে অনস্বীকার্য কিছু সত্য কথা বলেছেন।


আর তাতেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের বর্তমান আধিপত্যবাদী ও দক্ষিণপন্থী শাসকরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। খেপে উঠেছেন 'আমেরিকা-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির' ইহুদিবাদী নেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেখানে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে কে কার চেয়ে বেশি ইসরায়েল রাষ্ট্রের বন্ধু, তা নিয়ে চলছে প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতা। ঠিক তখনই গুন্টার গ্রাসের উল্লিখিত কবিতাটি যেন আগুনে আরো জ্বালানি ঢেলে দিয়েছে। জার্মানির বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ছাড়াও 'দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস' এবং লন্ডনের প্রগতিবাদী 'দ্য গার্ডিয়ানে' গ্রাসের কবিতাটিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদিবাদীদের তাঁর (গ্রাস) বিরুদ্ধে মাঠে নামতে আরো রসদ জুগিয়েছে।
এমন কী কথা বলেছেন গুন্টার গ্রাস, যা নিয়ে তাঁরা এত 'যুদ্ধংদেহি' হয়ে উঠেছেন? গ্রাসের সে কথা তো এত দিন আরো অনেকে বলেছেন, কিন্তু কেউ তা আমলে নেননি। আসল কথাটি চেপে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্নখাতে সরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ইসরায়েলের হাতে এত অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা কিভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি অসমর্থনযোগ্য অভিযোগের ভিত্তিতে ইরান আক্রমণের পাঁয়তারা করছে? তা ছাড়া যে জার্মানির কাঁধে এখনো গত দুটি বিশ্বযুদ্ধের দায় মানব ইতিহাসের কলঙ্কের বোঝার মতো চেপে আছে, তারা কিভাবে ইসরায়েলের বর্তমান চরম আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী দক্ষিণপন্থী সরকারের কাছে যুদ্ধজাহাজ বিক্রি করে, যা ইরানের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবে ব্যবহৃত হতে পারে? অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী লেখক হিসেবে গুন্টার গ্রাস সে কথা লিখে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলকে খোঁচা মেরে জাগাতে চেয়েছেন। আন্দোলিত করতে চেয়েছেন চরম হঠকারিতা ও আপস-কামিতার বিরুদ্ধে। জীবনের ৮৪ বছর বয়সে এসে গুন্টার গ্রাস ভেবেছেন এ সত্য প্রকাশ করা তাঁর একটি নৈতিক দায়িত্ব। নতুবা মৃত্যুর আগে তাঁর অপরাধবোধ থেকে তিনি মুক্ত হতে পারবেন না। এর পাশাপাশি গ্রাস ইরানের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তাঁর সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করেছেন অব্যর্থভাবে। তিনি অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর মতো ইরানের মোল্লাতন্ত্রও একই দোষে দুষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের অবরুদ্ধ মানুষের মুক্তি, মানবাধিকার এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে এর অবসান ঘটানো আবশ্যক বলে তিনি মনে করেছেন। 'যে কথা বলতেই হবে', কবিতায় বর্তমান বিশ্বের একজন প্রবীণতম কবি ও লেখক হিসেবে গুন্টার গ্রাস নিঃসংকোচে তা-ই তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর সে সহজ কথাগুলো সহজে বলতে পারেননি তিনি। সে কবিতার জন্য তাঁকে শুধু 'ইহুদিবিদ্বেষী' নয়, ইসরায়েল ভ্রমণ তাঁর জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শুরু করা হয়েছে এক বৈরী প্রচারাভিযান। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে গ্রাস জার্মানির নাৎসি বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছিলেন। যারা হত্যা করেছে লাখ লাখ নিরস্ত্র-নিরপরাধ জার্মান ইহুদিদের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সে দুঃখজনক ইহুদি নিধনকে এ পর্যন্ত কাজে-অকাজে বহুভাবে ব্যবহার করছে ইহুদিবাদী নেতানেত্রী এবং আমেরিকার প্রভাবশালী ইহুদী লবিস্টরা। চারদিকে আরব বেষ্টিত মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৪৮-এর ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রের একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা, এরপর আরবদের বিরুদ্ধে চার-চারটি যুদ্ধ, ফিলিস্তিন থেকে লাখ লাখ আরবকে সমূলে উৎখাত, জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ক্রমাগত অবৈধ বসতি নির্মাণ এবং বছরের পর বছর ধরে গাজা অবরোধ করে সেখানকার ফিলিস্তিনিদের মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করাকে অর্থ ঢেলে এবং বিভিন্নভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে জায়েজ করতে চান ইহুদিবাদী নেতা এবং বিশেষ করে তাঁদের মার্কিন বশংবদরা। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থ সম্পদ এবং অধিকাংশ শিল্প-কারখানার মালিক বহিরাগত ইহুদিরাই। তাদের ব্যাপক অর্থ মদদ (চাঁদা) ও রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের নির্বাচন এবং সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি জনসংখ্যা মাত্র ৭০ লাখের কাছাকাছি হলেও মূলত তারাই চালায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও অর্থনীতি। তাদের প্রভাবেই কংগ্রেসে অধিকাংশ বিল পাস হয়। ইরাক যুদ্ধের পেছনেও ছিল তাদের শক্তিশালী সমর্থন এবং এখন ইরান আক্রমণের ব্যাপারেও তারা অটল। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে- এমন কোনো মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বা শক্তির উদ্ভব হোক, সেটা দেখতে চায় না ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে অবরুদ্ধ গাজার হামাস এবং লেবাননের হেজবুল্লাহকে সমর্থন করে ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সর্বব্যাপী রণ হুংকারের সেটিই প্রধান উপজীব্য বিষয়। অথচ ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সে বছরেরই জানুয়ারিতে গাজায় সংঘটিত ইসরায়েলের তিন সপ্তাহব্যাপী (২২ দিন) অসম ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সশস্ত্র আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছিল। সে অমানবিক সশস্ত্র হামলায় গাজার এক হাজার ৪০০ নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি আরব নিহত হয়। কিন্তু ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শেষ পর্যন্ত তা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া ইরানসহ অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এবং তাদের কাছে থাকা অন্তত দুই থেকে চার শ পারমাণবিক অস্ত্রের কোনো তদন্তই করতে পারছে না আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কর্তৃপক্ষ (আইএইএ)।
সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্রের অধিকারী দেশ। তা জানা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, প্রশাসন এমনকি প্রেসিডেন্ট তা আড়াল করে রাখেন। তাঁদের যত বিষোদগার ও হুমকি-ধমকি ইরানের বিরুদ্ধে। অথচ ইরান বলছে শান্তিপূর্ণভাবে মানবকল্যাণের লক্ষ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। মারণাস্ত্র তৈরি নয়। সে ব্যাপারে তারা পরবর্তী তদন্তের জন্য আইএইএ-কে ইরান সফরের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তারা অবিলম্বে ইস্তাম্বুলে আলোচনায় বসতে চায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কূটনৈতিক দিক থেকে সব ধরনের আলোচনা চালাতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। কিন্তু আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ওবামা এখন বহু রকম খেলাই খেলে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদি লবির নেতারা এবং ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে গোপন আঁতাতের রাজনীতিতে এখন আকণ্ঠ নিমজ্জিত যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট ওবামা। ইরান ও ফিলিস্তিনের স্বার্থের বিরুদ্ধে ওবামা এমনকি সৌদি আরব ও জর্দানের মতো কিছু দেশও একজোট হয়েছে নানা ষড়যন্ত্রমূলক কূট-কৌশল নিয়ে। সে সুযোগে ক্রমেই ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেম গ্রাস করার চক্রান্তে তৎপর রয়েছেন ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতারা। তাঁরা সমগ্র পশ্চিম তীরে কৌশলগতভাবে অবৈধ বসতি নির্মাণের মাধ্যমে আরব ভূখণ্ড দখল করে নিচ্ছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে। আর এ ব্যাপারে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যাঁরাই প্রকাশ্যে কথা বলছেন তাঁদের একের পর এক চিহ্নিত বা অভিযুক্ত করা হচ্ছে 'ইহুদিবিদ্বেষী' হিসেবে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ইহুদি বিচারপতি রিচার্ড গোল্ডস্টোন, যিনি গাজায় সংঘটিত ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট দিয়েছেন, তাঁকেও ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি বৈরী বলে অভিযুক্ত করেছেন।
বিশ্বের প্রায় সব শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী লেখক-সাহিত্যিক এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা যারা করেন, তাঁরা অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে। তাঁরা বিশ্ব মানবতার মুক্তি, সব ধরনের বৈষম্যের অবসান এবং প্রগতিবাদের পক্ষে কাজ করে থাকেন। সে প্রক্রিয়ায় তাঁদের সত্যবাদিতা ও আপসহীন প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধই হচ্ছে শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং অধিকার বঞ্চিত মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। এ অবস্থায় ইহুদিবাদীরা যারা এক দিন হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নিধনের শিকারে পরিণত হয়েছিল, তারাই যদি আবার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নব্য নাৎসি শক্তিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তা হলে গুন্টার গ্রাসের মতো কবি ও সাহিত্যিককে তো কলম ধরতেই হবে। তাদের যেভাবেই অভিযুক্ত করা হোক না কেন। নতুবা অশুভ শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে বিশ্ব বিবেকের মৃত্যু ঘটবে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং 'প্যালেস্টাইন : এক সংগ্রামের ইতিহাস'-এর প্রণেতা।
gaziulhkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.