ডেসকোয় নিয়োগ-ভেলকি by আরিফুজ্জামান তুহিন

সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিতে (ডেসকো) একজন বোর্ড সদস্যের শ্যালক পরিচয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন ৩০ জন! অভিযোগ উঠেছে, এসব নিয়োগের মাধ্যমে অবৈধভাবে কম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা।


এর বাইরেও অর্থের বিনিময়ে কম্পানিটির কর্মকর্তা পদেও নিয়োগ পেয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে এসব নিয়োগ। একেকটি পদের বিপরীতে নেওয়া হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অধীনে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান ডেসকোতে এভাবেই চলছে নিয়োগ-বাণিজ্য।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, যে কর্মকর্তার শ্যালক পরিচয়ে ডেসকোতে ৩০ জন অস্থায়ী ভিত্তিতে (মাস্টার রোল) চাকরি পেয়েছেন, সেই কর্মকর্তার নাম ফয়েজ আহমেদ। তিনি ডেসকোর বোর্ড সদস্য ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। শুধু মাস্টার রোলেই নয়, কম্পানির উপব্যবস্থাপক পদেও নিজের আত্মীয় পরিচয়ে সাদেক মোহাম্মদ টিপু নামের একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন এই বোর্ড সদস্য। ডেসকোতে একটি কথা চালু আছে- 'আহা! কেন ফয়েজ দুলাভাইয়ের শালা হতে পারলাম না?'
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় ফয়েজ আহমেদ টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বোর্ড সভা চলছে। এখন কোনো কথা বলতে পারব না। ৩০ মিনিট পরে ফোন করেন।' এরপর আর তিনি ফোন ধরেননি। ডেসকোর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ। গত তিন মাসে তাঁর নির্দেশে সাতজনকে মাস্টার রোলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া তাঁর নাতি পরিচয়ে উপব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পেয়েছেন মো. কামরুল আহসান নামের এক ব্যক্তি। তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ রয়েছে। কামরুল আহসানকে প্রথমে নিয়োগ দেওয়া হয় সহকারী ব্যবস্থাপক পদে গত ২২ মার্চ। মাত্র ১০ দিনের মাথায় গত ১ এপ্রিল তাঁকে আবার নিয়োগ দেওয়া হয় আরো এক ধাপ ওপরের পদে (উপব্যবস্থাপক)। ডেসকো সূত্রে জানা যায়, ওই আটজনের কারোরই সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ পাওয়ার বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই।
সূত্র মতে, ডেসকো গত ১১ জানুয়ারি দৈনিক পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। বিভিন্ন পদে প্রায় ৫০ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। ওই সব পদে নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষার তারিখ পড়েনি। অথচ এর আগেই শুরু হয়ে গেছে নিয়োগ। নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে মাস্টার রোলে। গত ১১ জানুয়ারি চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে ১২ জানুয়ারি থেকেই মাস্টার রোলে নিয়োগ দিতে শুরু করেন ডেসকোর কর্মকর্তারা। গত ১২ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন।
মাস্টার রোলে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণের সিদ্ধান্ত দেয় ডেসকোর গিভেন্স কমিটি। এ কমিটি ডেসকোর পদোন্নতি ও অস্থায়ী নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কমিটির আহ্বায়ক হলেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফয়েজ আহমেদ। সদস্যসচিব হলেন ডেসকোর মহাব্যবস্থাপক (উন্নয়ন ও প্রকল্প) নূর মোহাম্মদ। সদস্য পদে আছেন ডেসকোর মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শফিকুল ইসলাম চৌধুরী এবং একজন বোর্ড সদস্য। এ কমিটি মাস্টার রোলে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ী করে থাকে।
ডেসকোর এক কর্মকর্তা জানান, প্রথমে দেওয়া হয় কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ। কিছুদিন চাকরি করার পর তাঁদের স্থায়ী করে নেয় গিভেন্স কমিটি। এভাবেই ফয়েজ ও নূর মোহাম্মদের অনেক আত্মীয় ডেসকোতে চাকরি পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে এক কর্মকর্তা জানান, গত ২০ নভেম্বর ডেসকোর কর্মকর্তার শতভাগ শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতির নির্দেশ দেয় (একবারের জন্য) বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা পেয়ে ডেসকো কর্মকর্তাদের পদোন্নতি শেষ করে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অবহিত করে। এরপর কম্পানির অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সহকারী ব্যবস্থাপক থেকে মহাব্যবস্থাপক পদ পর্যন্ত আর কোনো শূন্য পদ ছিল না। তার পরও সম্প্রতি বিভিন্ন পদে ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মো. মোফাজ্জেল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কম্পানির নিয়োগ বিধিমালা ভেঙে ব্যবস্থাপক পদে দুজন, উপব্যবস্থাপক পদে তিনজন এবং সহকারী ব্যবস্থাপক পদে ছয়জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ডেসকোর কোনো বিধি মানা হয়নি। একটি সূত্র জানায়, সদ্য নিয়োগ পাওয়া ১১ জনের কারোরই সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগ পাওয়ার বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট ডেসকোর ১৭৩তম বোর্ড সভায় যে জনবল কাঠামো ঠিক করা হয়, তাতে জুনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক 'গ্রেড-৮' পদের সংখ্যা ১০২। কিন্তু এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৯৮ জনকে। বাড়তি এই ৯৬ জনের নিয়োগ ডেসকোর কোনো বোর্ডসভা এখনো অনুমোদন দেয়নি। অথচ এর আগেই ১৯৮ জনের মধ্যে ৪৬ জনকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত এই ৪৬ জনের মধ্যে বাড়তি নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ৯৬ জনের অনেকেই রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি জুনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগের সময় কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর একটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ডেসকো চেয়ারম্যান শাহজাহান সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেয়। যদিও এ ব্যাপারে ডেসকো কর্তৃপক্ষের ভাষ্য হচ্ছে, কোনো দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য নয়, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় অন্যান্য কম্পানির চেয়ারম্যানদের মতোই ডেসকো চেয়ারম্যানকেও অব্যাহতি দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.