ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ by জাকির হোসেন

মাত্র দু'বছর আগের মন্দা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার আগেই বিশ্ব অর্থনীতি এখন আরেকটি সুনামির মুখোমুখি হচ্ছে। বিশ্বে আবারও যদি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী হবে_ তা নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই হিসাব কষতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, বিগত মন্দায় তেমন প্রভাব না পড়লেও এবার বেশ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে বিভিন্ন পণ্য ও জনশক্তি রফতানি কমবে। রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৈদেশিক ঋণ কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে। অর্থনীতিবিদরা আগেভাগেই সরকারকে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি : বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক ও গবেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির চলমান অস্থিরতা বড় ধরনের মন্দার দিকে মোড় নিলে কিছুটা প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়বে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে জানান, ইউরো জোন যেদিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তাতে আরেকটি মন্দার আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী এবং বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলো মন্দা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকবে। এর ফলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে বৈদেশিক ঋণ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাহিদা কমে গেলে রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। জনশক্তি রফতানির ওপরও আঘাত আসবে। তবে ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন। পলিসি রিসার্চ
ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হলে আমাদের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তবে কিছু প্রভাব বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে এবং সেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। এছাড়া আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আমরা যেসব পণ্য রফতানি করি মন্দায় সেগুলোর চাহিদা খুব বেশি কমে না। অন্যদিকে চীন থেকে পণ্য আমদানির চাহিদা কমছে, যা বাংলাদেশকে উপকৃত করবে। বৈদেশিক সাহায্য, জনশক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্স নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার কারণে কিছু ঝুঁকি রয়েছে যেগুলো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এসব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে_ রেমিট্যান্স ও রফতানি কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়া। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি এবং বেসরকারি খাতের ঋণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় সরকারের সামনে বিকল্প হলো সহজ শর্তে এবং কম সুদে বৈদেশিক ঋণ। এ জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে বড় অঙ্কের বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার জোর চেষ্টা চলছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হলে বিদেশি সহায়তা কমে যাবে। কম সুদে বৈদেশিক ঋণ না পাওয়া গেলে সরকারকে উন্নয়ন ব্যয় কমাতে হবে অথবা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি ঋণ নিতে হবে।
বিশ্ব অর্থনীতি : বিশ্বে আগের অর্থনৈতিক সংকটের উৎপত্তি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট মূল্যের বুদ্বুুদ থেকে। অতি মূল্যায়িত আবাসন খাত ঋণবাজারকে তছনছ করে দিয়েছিল, যা এক পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার কবলে ফেলে দেয়। সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টার মাঝেই নতুন করে সংকট শুরু হয়েছে ইউরোপ থেকে। ইউরোপের কয়েকটি দেশের সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। গ্রিসসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের সরকারি ঋণ (সভরেন ডেট) সংকট বিশ্ব অর্থনীতিকে আরেকবার বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। এসব দেশের সরকারি বন্ড ও অন্যান্য আর্থিক পণ্যে সারাবিশ্বের বিনিয়োগ রয়েছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ উন্নত অর্থনীতিতে কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কায় সারাবিশ্বেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছে। রাজনীতিবিদরা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হবেন_ এমন ধারণায় বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক ও গবেষকরা বলছেন, আমাদের আর্থিক খাত বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নয়। তবে মন্দা বিরাজ করলে চাহিদা কমে যাওয়ার পরিণতিতে অর্থনীতির প্রকৃত খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক জরিপে বিশ্বের বড় বিনিয়োগকারীরা আগামী বছর নাগাদ আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ব্লুমবার্গের ওয়েবসাইটে বৃহস্পতিবার জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে। ব্লুমবার্গ সারাবিশ্বের ১০৩১ জন বিনিয়োগকারী, বিশ্লেষক এবং ব্যবসায়ীর ওপর জরিপ করেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭২ শতাংশ বলেছেন, ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়বে। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ বলেছেন, এ অস্থিরতা ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশই বলেছেন, ইউরোজোনের অর্থনীতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার জার্মানির পার্লামেন্ট গ্রিসসহ ইউরো অঞ্চলের 'বেল আউট' ফান্ড সম্প্রসারণে রাজি হওয়ায় কিছুটা আশাও জাগ্রত হয়েছে।
বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত তিন মাসে (২২ জুলাই-২২ সেপ্টেম্বর) লন্ডনের শেয়ারবাজারের সূচক এফটিএসই-১০০ কমেছে ১৪ শতাংশ। নিউইয়র্কের ডাউ জোন্স কমেছে ১৫ শতাংশ এবং জার্মানির ডিএএক্সের পতন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হয়ে বেকারত্বের হার ৯ দশমিক ১ শতাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৯৪৫ সালের পর এ ঘটনা ঘটল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এক বিবৃতিতে বলেছে, আর্থিক বাজারে প্রচণ্ড চাপসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে ইউরোজোনের সরকারগুলোর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে উদ্বেগ বাড়ছে।
আইএমএফের সার্ভেইল্যান্স রিপোর্ট : সম্প্রতি ওয়াশিংটনে শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় আইএমএফ উপস্থাপিত সমন্বিত বহুপক্ষীয় সার্ভেইল্যান্স রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি বিপজ্জনক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। প্রকৃত অর্থনীতি এবং আর্থিক খাতের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বেড়েছে। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বেড়েছে অনিশ্চয়তা। ২০১১-১২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে প্রায় ৪ শতাংশে দাঁড়াবে। ২০১০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্রুত আস্থার পতন হচ্ছে। সরকারের ঋণ ঝুঁকি নিয়ে দুশ্চিন্তা ইউরোপের ব্যাংকিং খাতকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। ব্যাংকের শেয়ার মূল্য কমছে দ্রুতগতিতে। ইউরোপে ঋণখেলাপি প্রবণতা বাড়ছে এবং বেশ কিছু ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমেছে। সরকারের উচ্চমাত্রার ঋণ দায় এবং অর্থনীতিতে কম প্রবৃদ্ধি_ এ দুটি অবস্থা অর্থনীতি টেকসই হওয়ার পথে বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সরকার ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে ব্যাংকগুলো প্রচণ্ড সংকটে পড়বে। ইউরোপের পাইকারি ঋণ বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি থাকায় এ বাজারের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। আইএমএফ আশঙ্কা করেছে, ঋণবাজার আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। কমতে পারে চাহিদা। বাড়তে পারে বেকারত্ব। এমনকি খুব খারাপ অবস্থা না হলেও দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্পমাত্রার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক : সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে ২০১১-১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরো অঞ্চল ও জাপানের অর্থনীতিতে মাত্র দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ বলেছে, উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোতে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে, যা ২০১০ সালে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। আউটলুকে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলো সংকটে থাকায় উন্নয়নশীল দেশের রফতানিপণ্যের চাহিদা কমছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংকোচনমূলক নীতি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা প্রকারান্তরে প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে।

No comments

Powered by Blogger.