‘২৩ বছর ধরে লোকটি পাগল’—প্রসঙ্গে কিছু কথা by ইপিসতা আক্তার

১ ও ১৮ সেপ্টেম্বর পরপর দুটি ‘আইন অধিকার’ সংখ্যায় আনোয়ারুল মোমীন নামের এক চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবীকে নিয়ে তানজিম আল ইসলামের প্রতিবেদনগুলো পড়ে ২৫ তারিখেও এ সংক্রান্ত লেখা আশা করেছিলাম। না পেয়ে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। কেননা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এর একটা ইতিবাচক সমাধানের জন্য কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখছে, এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরল না হলেও একেবারে সাধারণ নয়।

তাই সাধারণ মানুষ এবং আনোয়ারের মতো আরও অনেক ভুক্তভোগী নিশ্চয়ই কৌতূহলী হয়ে আছে ঘটনার শেষটুকু জানার জন্য। আসলেই কি এর ইতিবাচক সমাধান হয়েছে, নাকি আরও অনেক ঘটনার মতো ‘ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের তদন্ত চলছে...’ এভাবেই ঝুলে আছে অথবা একটু আলোচিত হয়ে আবার হারিয়ে যাচ্ছে মহাকালের স্রোতে? প্রতিবেদনটি থেকে আরও কিছু কৌতূহলের উদ্রেক হয়। যেমন, এখানে বলা হয়েছে, একটি অন্যায় আদেশ পালনে অসম্মত হওয়া থেকে ঘটনার সূত্রপাত। কিন্তু সে আদেশটি কী ছিল তা জানা যায়নি। জানা গেলে কর্তৃপক্ষকেও হয়তো আরও সজাগ করতে সক্ষম হতো। তবে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, একজন মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে সততা এবং সাহসিকতার পরিচয় অবশ্যই দিতে পারে, তবে তা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে।
আনোয়ারের মতে, কর্মকর্তাদের ভয় ছিল যে তিনি তাঁদের অনেক অন্যায় কাজের সাক্ষী। তাঁর এমন ধারণার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না। যাঁরা দিনকে রাত বলে চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, এমন রাঘববোয়ালদের কেন চুনোপুঁটিকে ভয় হবে? বরং হতে পারে যে তাঁরা পেশাগত জীবনে আনোয়ারের দায়িত্বের সীমানা আর তাঁদের কর্তৃত্বের পরিসর তাঁকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন।
প্রতিবেদনের একপর্যায়ে বলা হয়েছে, একবার তাঁকে খোঁড়া অজুহাতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সে অজুহাত সত্য কি মিথ্যা ছিল, তা বলা হয়নি। মস্তিষ্কের রোগ চোখে দেখা না গেলেও শারীরিক সমস্যা দৃশ্যমান, এদিক থেকে অজুহাত সত্য বলে ধরে নিলেও তিনি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার পর খোঁড়া হয়েছিলেন নাকি আগেই সমস্যা ছিল কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে তা বাধা সৃষ্টি করেনি—তা জানার অবকাশ থেকে যায়। অপরদিকে অর্থ আর প্রভাব থাকলে যে দেশে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও প্রভাবিত করা যায় সেখানে কর্তৃপক্ষই বা কেন কোনো ভুয়া চিকিৎসা সনদ জোগাড় করেনি তাও রহস্যময় বলে মনে হয়। প্রতিবেদনে আনোয়ারুলের সহকর্মী, প্রতিবেশী, আত্মীয় বা পরিচিত কারও বক্তব্য তুলে ধরলে আলোচনা আরও গভীরতা পেতে পারত।
সর্বোপরি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে এটা সত্যিই আশা জাগানিয়া। অতঃপর গণমাধ্যমের নীরবতা থেকে এটা ধরে নেওয়া যায় যে লোকটি নির্দোষ। আর তাই যদি হয়, তবে প্রশাসন তাঁকে হারিয়ে যাওয়া ২৩টি বছর ফিরিয়ে দিতে না পারলেও তাঁর পাওনাদি বুঝিয়ে দিতে পারবে এবং দেবে, এটাই সাধারণ মানুষের কামনা। এতে সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন না হলেও সাধারণ মানুষের হূত আত্মশক্তি কিছুটা হয়তো ফিরে আসবে। একই সঙ্গে বহুকাল আগে জাতীয় কবির সমাজের প্রতি রেখে যাওয়া প্রশ্ন: ‘এমনি করিয়া কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ এর উত্তরে সমাজ বলতে পারবে, ‘না।’
*ইপিসতা আক্তার। এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.