বিএনপির এক কথাঃ হবে না, হবে না, হবে না by মোশাররফ বাবলু

খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসতেই হবে-প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাব দেবেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতারা প্রশ্ন তোলেন, নিউ ইয়র্কে এক ধরনের বক্তব্য আর দেশে ফেরার পর আরেক ধরনের বক্তব্য, এটা কিসের আলামত? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিছক চমক সৃষ্টি ও জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেন, 'আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হবে না, আমরাও একই দাবিতে এখনো বহাল আছি। সেটা হলো-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হবে না, হবে না, হবে না।'

গত মঙ্গলবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার খালেদা জিয়ার হুমকির জবাবে গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই নির্বাচন হবে, হবে, হবে। জনগণ নির্বাচন করবেই, করবেই, করবেই। উনি (খালেদা) এত কথা বলছেন, উনিও নির্বাচনে আসবেন। ওনাকে নির্বাচনে আসতেই হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচনে আসতেই হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্যরা। এর আগে গত মঙ্গলবার ঢাকায় চারদলীয় ঐক্যজোটের মহাসমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার দলের একটি যোগদান অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেছেন, রোডমার্চ কর্মসূচির পরই শুরু হবে সরকার পতনের ফাইনাল খেলা। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর অপেক্ষা করা যাবে না। এর আগেই স্বৈরাচারী এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেছেন, 'সরকারি দলের যে নেতা যা-ই বলুক, আমি বলছি, আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হবে না, হবে না। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, আগামীতেও তাই হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দেবেন খালেদা জিয়া : প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক জবাব দেবেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যালোচনা করেই দুই-তিন দিনের মধ্যে এর জবাব দেবেন তিনি। বিশেষ করে ঢাকা থেকে সিলেট বিভাগে রোডমার্চ কর্মসূচি উপলক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন সংবাদ সম্মেলন করবেন। তখনই তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে দলের একটি সূত্রে জানা যায়।
বিএনপির নেতাদের প্রতিক্রিয়া : বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়ে জাতি বিভ্রান্তিতে পড়েছে। নিউ ইয়র্কে এক ধরনের বক্তব্য, আবার দেশে ফেরার পর আরেক ধরনের বক্তব্য, এটা নিছক চমক সৃষ্টির জন্য বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসতেই হবে-প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ কথা কেন বললেন, তিনিই হয়তো ভালো জানেন। নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেছেন তাতে সমঝোতা ও আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে ফিরে নতুন করে বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাহলে নিউ ইয়র্কে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত কেন করলেন, এর জবাব প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বিএনপি সাড়া দেবে কি না জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে কোনো আন্তরিকতা নেই। এটা লোক দেখানো, স্ববিরোধী কথা। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোশাররফ বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী কোন ভিত্তিতে বললেন, খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসতেই হবে-এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী আসলে কী বলতে চান, তা স্পষ্ট করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকেই সব কিছু খোলাসা করে বলতে হবে, সব কিছু চূড়ান্ত করতে হবে। কারণ নিউ ইয়র্কে বক্তব্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা নাকচ করে দিয়েছেন।' ড. মোশাররফ বলেন, যে যত কথাই বলুক না কেন, দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না। বিএনপিও জনগণের দাবির সঙ্গে একমত বলে মনে করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে যেকোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারেন। তবে সেখানে খোলা মন নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে জাতি বিভ্রান্ত। দেশে ফিরে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন, এটা ঠিক আছে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে সঠিক রাজনীতি হবে না। তিনি বলেন, 'আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আমারও একই কথা বলি-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, হবে না। এ জন্যই আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে।'
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, 'আওয়ামী লীগ দাবি করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে হয়েছে। হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ কেন আবার মত পরিবর্তন করল, আমাদের জানা নেই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে, এটা তারা বুঝতে পেরেছে।' তিনি বলেন, '২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমরা সরকারে ছিলাম। ইচ্ছে করলে আমরাও সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। কারণ আমরা বাকশালে বিশ্বাসী নই। বিএনপিই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমান জাতীয় সংসদকে একদলীয়ভাবে সাজিয়েছে সরকার। এতেই প্রতীয়মান হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে। তাই রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠছে তারা। কিন্তু আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া মহাসমাবেশে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হবে না, হবে না, হবে না। আমারও বলি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া অন্য কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে না, নেবে না।'
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের এক দফা এক দাবি-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।' খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসতেই হবে-প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপিকে দুর্বল ভাবাটা ঠিক নয়। বিএনপি কারোটা খেয়েপরে বেঁচে নেই যে নির্বাচনে ডাকলেই অংশ নেবে।
দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিলেন কেন-প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে চমক সৃষ্টি করতে চাইছেন। ছিয়াশি সালে এরশাদ সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন করেছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে ক্ষতি কী? অর্থবহ নির্বাচন না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, এটাই সাফ কথা।'

No comments

Powered by Blogger.