হায় জাতীয় লিগ! by তারেক মাহমুদ

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হিসেবে জাতীয় লিগ দিনে দিনে তাঁর মর্যাদা হারাচ্ছে। ক্রিকেট কর্মকর্তাদের কাছে যখন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের চেয়ে ক্লাবের স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়, এই পরিণতিই তো হওয়ার কথা! এমন একটা দিন আসবে যখন জাতীয় লিগ টিকে থাকবে শুধু টেলিভিশনের টক শোতে, পত্রিকায় ছাপা হওয়া বিক্ষুব্ধ কলামে। সাবেক ক্রিকেটাররা, ক্রিকেট-ভাবুকেরা হায়-হায় করে কপাল চাপড়াবেন। আমরা ‘ক্রিকেট জাতি’ অথচ ক্রিকেটের মেরুদণ্ডটাকে কীভাবেই না ভেঙে ফেললাম! আফসোস। আফসোস। আপাতত ‘আফসোস’টা আশঙ্কার পর্যায়ে। আশা করা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেট কখনো এমন দুর্দিন দেখবে না। তবে দেশের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট আসর জাতীয় লিগের প্রতি ক্রিকেট বোর্ডের উদাসীনতা দেখে, এই লিগ নিয়ে যারপরনাই খামখেয়ালিপনায় ভয় জাগেই।

সাম্প্রতিক উদাহরণটাই শুনুন। বেশি বেশি ক্রিকেটারদের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলানোর জন্য জাতীয় লিগের দল ছয়টি থেকে আটটি করা হয়েছে। বোর্ডসভায় এই সিদ্ধান্ত হওয়ার দিন তিনেকের মধ্যেই জানা গেল উল্টো খবর। ক্রিকেটার-সংকটের কারণে নাকি এবার জাতীয় লিগ হওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তা! হলেও তারকা ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতে সেটি আলো ছড়াবে না বলে মন খারাপ টুর্নামেন্ট কমিটির কর্মকর্তাদের। জাতীয় লিগ যখন হবে বলে তাঁরা ঠিক করে রেখেছেন, তখন আন্তর্জাতিক সিরিজ আছে। তারকা ক্রিকেটারদের পেতে যে এসব সিরিজের সময়টা বাদ দিয়ে জাতীয় লিগ হবে, সেই উপায়ও নেই। তাহলে কোপ পড়ে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে। জাতীয় লিগের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ক্লাব ক্রিকেটে হাত দেওয়ার সৎসাহস বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কখনো ছিল না। বাজি ধরে বলা যায়, আজও নেই।
টেস্টখেলুড়ে কোনো দেশে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে ছাপিয়ে ক্লাব ক্রিকেটের বেশি গুরুত্ব পাওয়ার নজির একমাত্র বাংলাদেশেই আছে। কারণটা ব্যাখ্যার অতীত। ক্রিকেট বোর্ডের রাঘববোয়াল কর্মকর্তারা সব ক্লাব প্রতিনিধি, তাঁদের কাছে ক্লাব সবকিছুরই ঊর্ধ্বে। আর ঢাকার বাইরে থেকে যাঁরা আসেন তাঁদের জন্য ক্রিকেট পরিচালনায় যুক্ত হওয়ার চেয়ে কোনো রকমে বোর্ডে থাকাটাই বেশি ‘সম্মানে’র। আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার মরীচিকা যত দিন না বাস্তব হয়ে ধরা দেবে, এভাবেই চলবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের ভরাডুবি হবে। সবাই কদিন সমস্বরে বলবে, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সামনের মৌসুম থেকেই...। সামনের মৌসুম আসতে আসতে আবার সেই দায়সারা আয়োজন। ৫০ ওভারের ক্লাব ক্রিকেট নিয়েই সব মাতামাতি।
এ দেশে ক্রিকেটের মৌসুম মাত্র ছয়-সাত মাসের। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টির ঝাঁপটা নিয়ে শুরু, এপ্রিল-মে মাসে মৌসুম শেষ হওয়ার আগে আবারও বৃষ্টির ঝাঁপটা। মাঝের সময়টাতে জাতীয় লিগ হয়, হয় কয়েক রকমের ক্লাব ক্রিকেট—আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, মেয়েদের ক্রিকেট ইত্যাদি। সম্প্রতি বিপিএল নামে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্টও ওই সময়ের ভেতরেই ঢোকানোর চিন্তা ঘুরছে বোর্ডের মাথায়।
ক্রিকেট-বিশ্বে এখনো ‘ছোট ভাই’ হয়ে থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কখন কোথায় খেলতে হবে, এসব ব্যাপারে সিংহভাগ সময় ‘বড় ভাই’দের মর্জি মেনে নিতে হয় বাংলাদেশকে। তবে হোম সিরিজ হলে সেটা অবশ্যই বৃষ্টির সময়ে নয়। বৃষ্টিতে খেলা পণ্ড হওয়া মানে বাংলাদেশের ‘ক্রিকেট কন্ডিশন’ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাওয়া। টেলিভিশন সম্প্রচারের আয়েও পড়ে কোপ। মৌসুমের বাকি যে সময়টুকু হাতে থাকে, আজ পর্যন্ত তাতে অগ্রাধিকার পায়নি জাতীয় ক্রিকেট।
আন্তর্জাতিক সিরিজের জন্য এ দেশে ক্লাব ক্রিকেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কমই, হলেও একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও। সিরিজ খেলার জন্য জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে পারবেন না? ঠিক আছে ওই সময় জাতীয় লিগ দিয়ে দাও। ক্রিকেট মৌসুমে সময় দেওয়া যাচ্ছে না! ঠিক আছে জাতীয় লিগের অর্ধেকটা ভাসিয়ে দাও বৃষ্টির জলে। জাতীয় লিগ যেন শুধু হওয়ার জন্য হওয়া। যত ছুরি-কাঁচি চালাও এর ওপর দিয়েই। তবু অক্ষত থাকুক ক্রিকেট রাজনীতির আধার ক্লাব ক্রিকেট। ওটাকে তারকা দিয়ে সাজাতে হবে, বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতেও করা যাবে না। গন্ডায় গন্ডায় টাকা দিয়ে খেলোয়াড় কিনে যদি তাঁদের না-ই খেলানো গেল, সেই খেলার মানে কী? কাজেই ক্লাব ক্রিকেটকে মৌসুমের সেরা সময়টাই দিয়ে আসছে এ দেশের ক্রিকেট।
হওয়া উচিত উল্টোটা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটসূচি তৈরিতে যেহেতু এখনো বাংলাদেশের জোরালো বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই, বিসিবির উচিত এর পরই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটই হতে হবে মৌসুমের সেরা সময়ে, সম্ভব হলে সেরা ক্রিকেটারদের অন্তর্ভুক্ত করে। ক্লাব ক্রিকেট এখন ক্রিকেটারদের কাছেও যে কারণে জাতীয় লিগের চেয়ে ‘আকর্ষণীয়’, সেটা নিয়েও নতুন করে ভাববার আছে। পেশাদার ক্রিকেটারদের মূল আয়ের উৎস বানানো উচিত এটাকেই। ইংরেজিতে ‘মানি টকস’ বলে একটা কথা আছে। আজকাল যে ক্রিকেটেও কথাটা নানাভাবে চলে এসেছে, ক্রিকেট কর্মকর্তারা সেটা বুঝবেন না, তাই কি হয়!
ক্লাব ক্রিকেটের আলোচনা উঠলেই অনেকে নস্টালজিক হয়ে যান। একসময় আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে কত উত্তাপ ছিল, কত দর্শক হতো, কত চাপ থাকত! সেসব এখন না দেখে তাঁরা হাপিত্যেশ করেন। ক্লাব ক্রিকেটে অতীত উত্তেজনা ফিরিয়ে আনার আলোচনা তাঁদের ‘শখ’ বলতে পারেন । কিন্তু কেউ কেন বোঝে না, টেস্টখেলুড়ে দেশ হয়ে যাওয়ার পর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত দূর চলে আসার পর ক্লাব ক্রিকেটের এই পরিণতি হতেই পারে। মূলধারার ক্রিকেট হওয়া উচিত এখন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটই। ক্লাব ক্রিকেট বেঁচে থাকবে কেবল আঞ্চলিক ক্রিকেট হিসেবে। সেটি আগের মতো জমে উঠলে ভালো, তবে সেখানে ঢাকা লিগ আর রাজশাহী লিগের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আঞ্চলিক পর্যায়ের ক্লাব ক্রিকেটে যাঁরা ভালো করবেন তাঁরা পর্যায়ক্রমে জেলা, বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় পর্যায়ে আসার দাবি জানাবেন। ক্রিকেটার উঠে আসার এই পথটা প্রতিষ্ঠিত করতে সবার আগে চাই আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা। বহু বোর্ড, বহু বোর্ড সভাপতি যেটির কেবল প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক ভাষণ বাস্তবতায় রূপ দেননি।
ক্রিকেট বোর্ড চালান সংগঠকেরা। সেই সংগঠকদের কেউ সাবেক ক্রিকেটার, কেউ ক্লাব কর্মকর্তা কেউ বা ঢাকার বাইরে থেকে আসা ক্রীড়া-কেউকেটা। ক্রিকেট পরিচালনায় তাঁদের কাছে দূরদৃষ্টি প্রত্যাশা করা যায়। ক্রিকেটের মঙ্গলে অন্যরা যা ভাবতেও পারবেন না, তাঁরা সেটা করে দেখাবেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট যে রকম লক্কড়ঝক্কড় চলা চলছে, এর জন্য আসলেই কি খুব বড় সংগঠক হওয়ার প্রয়োজন আছে? সৃষ্টিশীল কোনো চিন্তা নেই, গড্ডলিকা প্রবাহে চলছে সবকিছু। রাম-শ্যাম-যদু-মধুর হাতে ছেড়ে দিলেও কি এভাবেই চলত না ক্রিকেট!
ক্রিকেট নিয়ে এসব প্রসঙ্গ উঠলেই কিছু সীমাবদ্ধতাকে ঢাল হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন কর্মকর্তারা। এটা বাংলাদেশ...চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না...আর্থিক সমস্যা...রাজনীতি...আবহাওয়া—আরও কত যে সমস্যা! কিন্তু এসব সমস্যার ভেতর দিয়েও ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলেই তো আপনারা ক্রিকেট কর্মকর্তা! বোর্ডে আছেন! যদি না-ই পারেন, ‘পারছি না’ বলে সরে যান। এ রকম ক্রিকেট যে কেউ চালাতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.