প্রধানমন্ত্রী বললেনঃ হবে, হবে, হবে

ত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার হুমকির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই দেশে নির্বাচন হবে, হবে, হবে। জনগণ নির্বাচন করবে, করবে, করবে। খালেদা জিয়াকে সেই নির্বাচনে আসতেই হবে। রাজনীতি করলে নির্বাচনে আসতে হবে। যুদ্ধাপরাধী, মানি লন্ডারিং মামলার আসামি ও দুর্নীতিবাজদের বাঁচানোর জন্য বিএনপির আন্দোলন_এ কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, 'নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন। সময় হলেই নির্বাচন হবে। দেশের জনগণ নির্বাচন চায়, ভোট দিতে চায়। কারণ এটা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার সুরক্ষিত চায় সবাই। সে জন্য তারা নির্বাচন চায়।' জনগণ নির্বাচন না চাইলে তখন সে রকম ক্ষমতা তিনি চান না বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানাতে গতকাল শনিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না_খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী উলি্লখিত কথাগুলো বলেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বৃহস্পতিবার দলে এক যোগদান অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটিতে দেওয়া ভাষণে 'চোর-বাটপারদের সঙ্গে আলোচনায় বসব না'_শেখ হাসিনার এই উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত বক্তৃতা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বক্তব্যটি যেভাবে এসেছে, আমি সেভাবে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি ওনার (খালেদা জিয়া) সঙ্গে আলোচনায় বসলে উনি তো দুর্নীতিবাজ ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবেন। উনি তো রাজনৈতিক কথা বলবেন না।'
চলমান রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করতে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে কি না প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'তিনি (খালেদা) তো সময় বেঁধে দিয়েছেন সরকার উৎখাতের, তাহলে আর আলোচনা কিসের? সংসদে আসুক, সংসদে কথা বলুক, সংসদেই আলোচনা হবে।'
একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে বিরোধী দলের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'অবশ্যই উত্তম প্রস্তাব। আলোচনার মাধ্যমে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, সেটা আমরাও চাই।' তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আজকের বিরোধীদলীয় নেতাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'উচ্চ আদালতের রায় মানবেন না কেন?' ওয়ান-ইলেভেনে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফেরার বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতা তো কম্প্রোমাইজ করে রেখেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার। আমি আসব শুনে শক্ত হলেন। আমি তখন ঝুঁকি নিয়েছিলাম বলেই দেশে নির্বাচন হয়েছে, গণতন্ত্র এসেছে। খালেদা জিয়া কী আশায়, কোন কল্পনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইছেন, জানি না।'
গত ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের রাজধানীতে কমান্ডো স্টাইলে হামলা এবং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা এখনো কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার চিন্তা-ভাবনা করছি না। তবে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে, তাদের বিচার অবশ্যই হবে।' জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার তাঁর সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।
মন্ত্রিসভায় রদবদলের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মন্ত্রিসভার পরিবর্তন আমাদের এখতিয়ার। যখন সময় হবে, তখন দেখা যাবে।' মন্ত্রিসভার সমালোচনাকারীদের জবাবে তিনি বলেন, 'মন্ত্রীরা স্মার্ট নন, কাজ পারেন না। আমিও বলি, তাঁরা একটা ব্যাপারে স্মার্ট নন, সেটা হলো_দুর্নীতি। তাঁরা দুর্নীতি পারেন না; তবে দেশের মানুষের জন্য খাটাখাটুনি করেন, শ্রম দেন।'
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই শেখ হাসিনা তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং গত ২৭ সেপ্টেম্বর চার দলের মহাসমাবেশে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাব দেন। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, 'নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে অবদানের জন্য সাউথ সাউথ পুরস্কার আমাকে নয়, বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে।'
'রোডমার্চের পরে ফাইনাল খেলা, আগামী সেপ্টেম্বরের পরেই এই সরকারকে বিদায় নিতে হবে'_খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, এর পরই না ফাইনাল। তিনি (খালেদা জিয়া) কোন স্টেজে আছেন?' প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে যত খেলুক, খেলনেওয়ালারা খেলে যাবে। যারা কাজ করার, তারা কাজ করেই যাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, 'এর আগে তিনি (খালেদা জিয়া) গত জুন পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। এখন আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বাড়িয়েছেন। ১৫ মাস সময় বাড়িয়েছেন_এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।'
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়া তৎকালীন পরিস্থিতিকে 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সে সময় জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি দাবি করে উনি কি সেই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চান? উনি কী ওনার আর ওনার দুই ছেলের ওপর অত্যাচারের কথা ভুলে গেছেন?'
আলোচনার মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনার নিয়োগের জন্য খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে 'উত্তম প্রস্তাব' আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা চাই আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক। সবার মতামতের ভিত্তিতে স্বাধীন, শাক্তশালী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।'
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'জিনিসের দাম বেড়েছে সত্যি, তবে এর সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। আগে যে এক শ টাকা আয় করত, এখন সে তিন শ টাকা আয় করছে।'
জরিমানা দিয়ে খালেদা জিয়ার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'একটা দেশের সরকারপ্রধান যদি দুর্নীতি করে টাকা কামান, আর জরিমানা দিয়ে সেই টাকা সাদা করেন তাহলে বুঝুন, দেশটা কোথায় তলিয়ে যাচ্ছিল?'
দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে বাজেট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা দুই বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন দুই হাজার মেগাওয়াট বাড়িয়েছি। ওনারা পাঁচ বছরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়েছিল।' ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো করা নিয়ে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'ওনার মিথ্যা আশ্বাস জনগণ বিশ্বাস করবে না।' গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে তৃমাত্রিক রিগ কেনার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি। ৯টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদনের কাজ চলছে।'
জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও কৃষিতে বার্ষিক ২২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব কিছুতে ভর্তুকি দিলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিভাবে হবে?
র‌্যাব ও পুলিশকে প্রশিক্ষণ না দেওয়ার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতি খালেদা জিয়া যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'র‌্যাব তাঁদের সৃষ্টি।' ২০০৫ সালে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, 'ক্রসফায়ার মিডিয়ার ভুল ব্যাখ্যা। র‌্যাব ও সন্ত্রীদের বন্দুকযুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিজেদের রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।' শেখ হাসিনা বলেন, 'সে সময় আমিই প্রথম ক্রসফায়ারের প্রতিবাদ করেছিলাম।'
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত টকশোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মধ্য রাত পর্যন্ত জেগে থেকে টকশো দেখা হয় না। মাঝেমধ্যে দেখি। টকশো টকই হয়ে যায়। একটু মিষ্টি না থাকলে তা ভালো হয় না।' তিনি বলেন, 'যে সাংবাদিকরা বা গণমাধ্যমগুলো রাজনীতিবিদ ও সরকারের ঢালাও সমালোচনা করে, তাদেরও সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করা গেলে সাংবাদিকদের কেন সমালোচনা করা যাবে না?'
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে গণভবনের হলরুমের মূল মঞ্চে শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো উপস্থিত ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, মাহাবুব-উল-আলম হানিফ, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম, পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.