মালদ্বীপ সঙ্কট : প্রতিবেশীদের ভূমিকা by এম. কে বাশার

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতারা হয় সরকারে অথবা বিরোধী দলে থাকবেন এবং পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবেন এটাই মনে করা হয়। কিন্তু মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক পার্টির (এমডিপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাশিদের মতে, মালদ্বীপে ‘আপনি হয় সরকারে থাকবেন অথবা কারাগারে’। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে রাজনৈতিক বিরোধীদের কারারুদ্ধ করার ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে। মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নাশিদসহ ৯ জন বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া রায় বাতিল করে দিয়ে সরকারের প্রতি তাদের মুক্তিদানের নির্দেশ দিলে দেশটিতে সঙ্কট শুরু হয়। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি দেশে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অত্যধিক ক্ষমতা দেন এবং সংবিধানের অংশবিশেষ স্থগিত ঘোষণা করেন। কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অপর একজন বিচারপতিকে গ্রেফতার করে। রাতে নাশিদের পূর্বসূরি, দীর্ঘ দিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকেও আটক করা হয়। উল্লেখ্য, গাইয়ুম দীর্ঘ ৩০ বছর মালদ্বীপ শাসন করেছেন এবং তার শাসনামলেও নাশিদ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন গাইয়ুমের সৎ ভাই। কিন্তু গাইয়ুম এখন বিরোধী দলের সাথে জোটবদ্ধ। দেশটিতে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিতে কর্মরত একজন ভারতীয়সহ দু’জন সাংবাদিককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। মুহাম্মদ নাশিদকে ২০১৬ সালের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার পর থেকে তিনি নির্বাসনে আছেন। মালদ্বীপে ফিরে এলে তার গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি আছে। আটক বিচারপতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করার জন্য তিনি ভারতের প্রতি তার দেশে ‘সামরিক বাহিনীর’ সমর্থন নিয়ে একজন দূত পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু তখন থেকে এ পর্যন্ত ভারত দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয় এড়িয়ে গেছে। ভারত এক বিবৃতিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিতে সরকারের অস্বীকৃতি এবং জরুরি অবস্থা আরোপ করাকে ‘গোলযোগপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। নয়াদিল্লি অবশ্য নাশিদের সামরিক হস্তক্ষেপের আবেদনের কথা উল্লেখ করেনি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের দু’জন শীর্ষস্থানীয় বিচারপতির গ্রেফতারে ‘উদ্বেগ প্রকাশ’ করেছে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসঙ্ঘ মালদ্বীপের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সাথে মতবিনিময় করেছে।
হোয়াইট হাউজ জানায়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। অপর দিকে, চীনের সরকারি মিডিয়া ইয়ামিন সরকারের সমর্থনে এগিয়ে আসে। মালদ্বীপের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। উল্লেখ্য, চলতি বছরের শেষে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এতে বিরোধী পক্ষ অংশ নিতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। এখন পর্যন্ত, ক্ষমতার তীব্র লড়াইয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন এগিয়ে রয়েছেন। মালদ্বীপে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভারত ও চীনের মধ্যে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ব্যাপক লড়াই শুরু হওয়ায় পর্যবেক্ষকেরা উদ্বিগ্ন। মালদ্বীপের প্রবালদ্বীপ এবং সি-লেইনগুলোর বিশাল বাণিজ্যিক ও কৌশলগত মূল্য রয়েছে। এটা উভয়পক্ষের জন্যই অনুকূল বলে মনে হয়। একটি দুর্বল মালদ্বীপ উগ্রবাদ, চোরাচালান এবং মাদক পাচারের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে বলে নয়াদিল্লির আশঙ্কা। দ্বীপ রাষ্ট্রটির সাথে ভারতের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু কিছু দিন ধরে এবং বর্তমানে উভয় দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বিশেষত মালদ্বীপ তাদের ‘ভারত প্রথম’ নীতিকে অগ্রাহ্য করে চীনের সাথে একটি মুক্তবাজার চুক্তি স্বাক্ষর করার পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। চীন ভারত মহাসাগরে তাদের মেরিটাইম সিল্ক রোড প্রজেক্টের জন্য মালদ্বীপকে চাবিকাঠি তথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছে। এ ছাড়াও চীন দ্বীপপুঞ্জবিশিষ্ট দেশটির দু’টি দ্বীপও নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে গেছে। চীন মালদ্বীপের রাজধানী মালের সাথে হুলহোলি দ্বীপকে সংযুক্ত করার জন্য মৈত্রী সেতুসহ বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে অর্থ সরবরাহ করছে এবং তাদের দাবি করা ভূখণ্ড এক হাজার অ্যাপাার্টমেন্ট হাউজিং প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করেছে। সেখানে চীনের উপস্থিতি বিশেষভাবে পর্যটন ক্ষেত্রেও বিস্তৃত করা হয়েছে। এখন ইউরোপের পর্যটকেরাই মালদ্বীপে পর্যটনের বৃহত্তম উৎস। আমরা আশা করি, ভারত ও চীন পরিস্থিতির অবনতি ঘটার মতো কোনো কিছু করবে না। দেশটিতে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে মালদ্বীপের কিছু রাজনীতিবিদের আহ্বানের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান সতর্কতা পূর্ণ। এদিকে চীন বাইরের যেকোনো অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দিয়ে স্পষ্ট করেছে- তারা এই ইস্যুকে বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যে আরেকটি ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ হতে দিতে চায় না।চীন জানিয়েছে, তারা সঙ্কট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার লক্ষ্যে ভারতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের মালদ্বীপের সঙ্কট দূর করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। হসৌদি গেজেট অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.