বইমেলা, লেখক ও প্রকাশনাশিল্প by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাংলা একাডেমি চত্বরে, এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত প্রসারিত, একুশের বইমেলা বাংলাদেশের সংবাৎসরিক বৃহত্তম সাংস্কৃতিক ঘটনা। আয়োজনের দিক থেকে এবং স্থায়িত্বের দিক থেকেও। মাসব্যাপী আয়োজন এবং অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার দিক থেকেও। একুশের বইমেলার আয়োজক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলা একাডেমি, সহযোগিতা দিয়ে থাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থাগুলো। তবে ৪৫০ প্রকাশকের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত, কিন্তু তাঁদের আগ্রহ-উৎসাহ অসামান্য। স্রেফ ব্যবসা তাঁদের লক্ষ্য নয়। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করাই তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। এই সবকিছু বিবেচনায় একুশের বইমেলাকে যে প্রাণের মেলা বলা হয়, তা অর্থহীন নয়। এই বইমেলা লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের গণ্ডি পেরিয়ে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বই একটি জড়বস্তু হলেও তা প্রাণহীন নয়। সে হিসেবে বইয়ের মেলাকে প্রাণের মেলা বললে ভুল হয় না। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলনের উপলক্ষ হওয়ায় তা যে মিলনমেলা, তা বলাই বাহুল্য। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রাণের মেলা-মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই মেলা জাতীয় জীবনে, বিশেষ করে সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে কী ভূমিকা রাখছে, তার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। গত তিরিশ বছরে মেলা উপলক্ষে বা মেলার সময় বিপুলসংখ্যক নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে কোথাও এত সংখ্যক বই বের হয় কি না, আমার জানা নেই। এই সময়ে গ্রন্থকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্য হিসাবে, এবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৪ হাজার ৫৯১ টি। গতবারের মেলায় নতুন বই এসেছিল ৩ হাজার ৬৪৬ টি। অর্থাৎ এবার ৯৪৫টি বই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। আমার পরিচিত কয়েকজনের বই, যেগুলোর মলাটে আমার মন্তব্য থাকার কথা ছিল, ছাপা হয়েছে কিন্তু বাঁধাই না হওয়ায় মেলায় প্রকাশিত হতে পারেনি। আরও অনেক লেখক-লেখিকাকে মেলা শেষ হওয়ার এক দিন আগেও মাথা চাপড়াতে দেখেছি শেষ মুহূর্তে তাঁদের বই আলোর মুখ দেখতে পারেনি বলে। অন্যান্য বারের মতো নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতার বই-ই শীর্ষে-১ হাজার ৪৭২ টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গল্পগ্রন্থ ৭০১টি এবং তৃতীয় স্থানে উপন্যাস ৬৪৩ টি। বাংলা একাডেমির নিজস্ব জরিপে এবারের মেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে ৪৮৮টি মানসম্পন্ন। সংখ্যার দিক থেকে এটিও ছোট নয়। মননশীল বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ যথেষ্ট, তা বড় প্রকাশকেরা জানিয়েছেন। একশ্রেণির শৌখিন লেখক-প্রকাশক বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারলেও, পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় গুণমানসম্পন্ন বইয়ের পাঠক বাড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু ও গুণমানসম্পন্ন সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রথমা প্রকাশন পুরস্কৃত হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে সেরা প্রকাশক হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস, জার্নিম্যান বুকস, সময় প্রকাশন, চন্দ্রাবতী একাডেমি এবং কথা প্রকাশ। তাদের অভিনন্দন। এক মাসে প্রকাশিত নতুন বইয়ের মধ্যে চার হাজারের মতো বই মানসম্মত নয় বলে বিবেচিত হওয়া-এই তথ্য অবহেলা করার মতো নয়। যা মানসম্মত নয়, তা শ্রম দিয়ে টাকা খরচা করে বের করার প্রয়োজন কী? পাঠকসমাজে অপরিচিত বা নতুন লেখকের বই প্রকাশ এক কথা আর মানহীন বই প্রকাশ আরেক কথা। নতুন লেখক হলেই বই মানহীন হবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। অনেক নতুন লেখক তাঁর প্রথমটিতেই খ্যাতিমান হন। দ্য গড অব স্মল থিংস প্রকাশের আগে অরুন্ধতী রায় লেখিকা হিসেবে অপরিচিত ছিলেন। ঝুম্পা লাহিড়ী তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থেই কিস্তিমাত করেন। এবার যে সাত শতাধিক ছোটগল্পের বই বেরিয়েছে মেলার সময় তার লেখকদের মধ্যে সাতজন যদি বাংলা সাহিত্যে টিকে যান, সেটা খুবই আনন্দের কথা।
কবিতা ও গল্প-উপন্যাসের বই প্রচুর বেরিয়েছে, তা খুশির কথা সন্দেহ নেই। তবে মেলায় যদি নতুন তত্ত্বমূলক দু-চারখানা দর্শনের বই বের হতো, তা হতো অতি বড় প্রাপ্তি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম, জার্মানি ও পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো দেশে গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই যত বেরোয়, দর্শনের বই তার চেয়ে কম প্রকাশিত হয় না। দর্শন বলতে শুধু মেটাফিজিকস বা অধিবিদ্যা নয়, বিভিন্ন বিষয়ের দার্শনিক তত্ত্বমূলক বই। বই শুধু পাঠককে আনন্দ দেয় না, পাঠকের জীবন বদলানোর ক্ষমতা রাখে। সমাজ বদলে বইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ভলতেয়ার, রুশো, কান্ট, হেগেল, মার্ক্সের বই সমাজ পরিবর্তনে কী ভূমিকা রেখেছে, তা মানুষ জানে। তাঁরা ছাড়া আরও অগণিত লেখক ও দার্শনিকের বই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রেখেছে। সে ধরনের বই রোজ রোজ সব ভাষাভাষীর মধ্যে ভূরি ভূরি প্রকাশিত হয় না বটে, তবে অনেক ভাষাতেই কমবেশি প্রকাশিত হয়। গত ১০ বছরে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দার্শনিক বইয়ের সংখ্যা কত, আমার ধারণা নেই। বই রচনা প্রতিভাবান মানুষের কাজ। বই সুসম্পাদিত করে রুচিসম্মতভাবে প্রকাশ করা আরেক ধরনের করিতকর্মা মানুষের কাজ। যদিও বইয়ের বিষয়বস্তুই আসল, কিন্তু এই যুগে অঙ্গসজ্জা উপেক্ষা করার উপায় নেই। কারণ, বই একটি বস্তু বা পণ্য, তা দৃষ্টিনন্দন না হলে ক্রেতাকে আকর্ষণ করবে না। বইয়ের প্রকাশনা ও বইমেলা একটি অর্থনৈতিক বিষয়। ‘মেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশনা সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, এবার মেলায় মোট ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা গতবারের তুলনায় ৫ কোটি টাকা বেশি।’ [প্রথম আলো, ১ মার্চ] এতে প্রমাণিত হয়, হয় পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে, অথবা ভালো মানসম্মত বইয়ের প্রকাশনা বেড়েছে। জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনের জন্য প্রকাশনাশিল্প রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করে। কিন্তু প্রকাশনাশিল্পকে যতটা গুরুত্ব দেওয়ার কথা, সরকার তা দিচ্ছে না। এখানে পুঁজি খাটাতে হয়। লাখ লাখ শ্রমিক এই শিল্পে নিয়োজিত। মানসম্মত বইয়ের মতো তাদের জীবনযাত্রার মানের দিকেও দৃষ্টি রাখা দরকার। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সমস্যা নেই, কিন্তু প্রতিভাবান নতুন লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থের লেখক-প্রকাশকদের সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন এই জন্য যে ওই সব বইয়ের পাঠক সীমিত। নতুন প্রতিভাবান লেখকদের বই প্রকাশে কাগজে ভর্তুকিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। বইমেলায় ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনকে পৃথক জায়গা দেওয়া হয়।
সেটা খুব প্রয়োজনীয় ও ভালো উদ্যোগ। ছোটকাগজগুলোর স্টলে ঘুরে অনিয়মিত সাময়িকীগুলোর পাতা উল্টে মনে হয়েছে, বহু সম্ভাবনাময় লেখক তৈরি হচ্ছেন। অবহেলায় প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে। লিটল ম্যাগাজিনের প্রথাবিরোধী লেখকদের আনুকূল্য ও প্রণোদনা দিতে হবে। আজ আমরা যারা প্রতিষ্ঠিত, তারা একদিন অনেকেই লিটল ম্যাগাজিন দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম। একুশের বইমেলার অনেক বছর হয়ে গেল। যখন বইমেলা হতো না, তখনো বই প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সময় বইমেলা ছিল না। কিন্তু এ যুগে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। বইমেলা শুধু বই বেচাকেনার ব্যাপার নয়। সেখানে পাঠক বই নির্বাচন করার সুযোগ পান, যে বইটি ভবিষ্যতে তিনি কখনো কিনবেন। বই সমগ্র জাতির চেতনা ধারণ করে। জাতির সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় বইতে। গত ২০-২৫ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এখন প্রধান লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের একত্রে বসে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বইমেলার মান ও মর্যাদা বাড়াতে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বার্থে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.