স্মৃতিতে অমলিন আসমা জাহাঙ্গীর by সালমা আলী

১৯৮৫ সাল একজন আইনজীবী হিসেবে সেবার ব্রত নিয়ে সবেমাত্র আমার পথচলা শুরু। এর অব্যবহিত পরেই দেখলাম আসমা জাহাঙ্গীরকে একজন দৃঢ় এবং প্রত্যয়ী মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে, যার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আমাকে মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে ঐকান্তিকভাবে।
সে বছরই নভেম্বর মাসে আমার সুযোগ হয়েছিল লাহোর হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং পাঞ্জাব মহিলা আইনজীবী সমিতি আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করার। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত মহিলা আইনজীবীরা মানবাধিকার রক্ষার একাত্মতায় সম্মিলিত হন। অনেকের মধ্যে আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম আসমা জাহাঙ্গীরের কাজকে। এরপরে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা এবং কথা হয়েছে কিন্তু তিনি আমাকে আকৃষ্ট এবং অনুপ্রাণিত করেছেন প্রথম দিনেরই মতো। এ কারণে তাঁর প্রস্থান মেনে নেওয়া আমার জন্য সহজ নয় এবং নিতেও পারিনি। দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের একজন উদার ও অকুতোভয় মানবাধিকার আইনজীবীর এই প্রস্থান মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, যা সত্যিকার অর্থেই অপূরণীয়। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
‘নারী: পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকার’ বিষয়ে আয়োজিত সেমিনারটির সমন্বয়ক ছিলেন আসমা জাহাঙ্গীর; যেখানে প্রধান অতিথির আসনটি অলংকৃত করেন লাহোর হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মিয়া মো. আলী কাওসারি। বাংলাদেশ থেকে সালমা মাসুদ চৌধুরী (বর্তমানে বিচারপতি), আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, সৈয়দা আফসার জাহান, পারভিন ওয়াজেদ এবং আমিসহ আরও কয়েকজন অংশগ্রহণ করি। এ ছাড়া ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে বেশ কয়েকটি উপস্থাপনা ছিল সেমিনারটিতে, যার মধ্যে উল্লেখ করতেই হয় আইনজীবী সিগমা হুদার, ‘বাংলাদেশের নারীর আইনগত অধিকার’, সালমা মাসুদ চৌধুরীর ‘মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীর অধিকার’ এবং আইনজীবী আনোয়ারা ইদ্রিসের ‘বাংলাদেশের নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার’-এর বিষয়গুলোকে। পাকিস্তানের আইনজীবী হিনা জিলানি ‘নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার’ বিষয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া ভারতের আইনজীবী তাহমিনা পুনডানি মুসলমান ‘তালাকপ্রাপ্ত নারীর খোরপোষের অধিকার’ নিয়ে যে প্রবন্ধ পাঠ করেন, সেখানে শাহ বানুর কেস নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। কারণ, ৪৩ বছর সংসার করার পর পাঁচ সন্তানের জননী শাহ বানু যখন তালাকপ্রাপ্ত হন, তখন তাঁর বয়স ৭০ বছর। (মো. আহামেদ খান বনাম শাহ বানু এবং অন্যান্য ১৯৮৫)।
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দেশের নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো এবং এ থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে, সে বিষয়গুলো উঠে আসে সেমিনারে। এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় আসমা জাহাঙ্গীর ‘ফৌজদারি আইন ও দণ্ডবিধিতে এবং ১৯৭৯ সালের হুদুদ অর্ডিনেন্সে নারীর অবস্থান ও সুরক্ষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ পেশ করেন। যেখানে তিনি অত্যন্ত খোলামেলাভাবে ধর্ষণ ও ধর্ষিতা নারীকে জিনার অপবাদে কীভাবে অপরাধী করা হয়, সে বিষয়টি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা একজন নারীকে বিচার চাইতে গিয়ে বারবার কীভাবে নির্যাতনের শিকার হন, তার বাস্তব উদাহরণ দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেন, যা আমার স্মৃতিতে আজও গেঁথে আছে। নারীর আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার এবং নারীর অন্যান্য অধিকার বিষয়ে তার আলোচনা আমাদের মতো যারা আইন পেশাতে নতুন ছিলাম, তাদের জন্য ছিল শেখার এবং হৃদয়গ্রাহী করার বিষয়।
তাঁর কণ্ঠস্বর আমাদের হৃদয়ের গহিনে নাড়া দেয়। মূলত বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মুসলিম নারীদের ভরণপোষণ আদায়ের ক্ষেত্রে যে অমানবিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হচ্ছে, তা প্রতিহত করতে আইনজীবীদের একত্র হওয়ার আহ্বানও এসেছিল সেই সেমিনার থেকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্যি যে নারীর ভরণপোষণ আদায় সুনিশ্চিত করতে এখনো আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আসমা জাহাঙ্গীর সংখ্যালঘু নারীদের অধিকার রক্ষা, অনার কিলিং, ব্লাসফেমি এবং অন্যান্য মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, যা তাঁর পথচলাকে বারবার করেছে বিপৎসংকুল। কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক যোদ্ধা, যিনি মানবাধিকার রক্ষায় সব সময় ছিলেন আপসহীন ও সোচ্চার। মানবাধিকার-সংক্রান্ত মামলায় তিনি শুধু নিজ দেশে নন, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিরলসভাবে কাজ করে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। তিনি আজ না-ফেরার দেশে চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন কিছু স্বপ্ন, যা আমরা একসঙ্গে দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নপূরণে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি লাভের একমাত্র অবলম্বন।
সালমা আলী, মানবাধিকার আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.