আশা জাগানিয়া পাট

ব্রিটেনের সার্লস ফাউন্ডেশন একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। মর্যাদাপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের বাগান পরিচর্যায় ব্যবহূত হয় বাংলাদেশের পাটপণ্য। উচ্চমূল্যের এক পিস গার্ডেনিং পণ্যের দাম ২০০ পাউন্ডের মতো। পাঁচ বছর ধরে এ পণ্য রফতানি করছে ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড। উচ্চমূল্যের পাটপণ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড গাড়ির অভ্যন্তরীণ সজ্জায়ও ব্যবহার হয় বাংলাদেশের পাট। এভাবে বৈচিত্র্য এনে পাটে নতুন করে আশা জাগাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সরকারও সোনালি আঁশের সুদিন ফেরাতে সচেষ্ট। সরকারি পাটকলে লোকসানসহ কিছু সংকট থাকলেও সার্বিকভাবে উৎপাদন বাড়ছে পাটের। বাড়ছে অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ও রফতানি। ভালো দামও পাচ্ছেন কৃষক। নতুন করে আশা জাগাচ্ছে পাট। গ্রামের ক্ষেতের পাট গত কয়েক দিন উঠে এসেছে রাজপথে। রাজধানীর রোদ্দুর গায়ে লাগিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আঁটি আঁটি পাটখড়ি। সপ্তাহজুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কদ্বীপ ও সড়ক বিভাজন পাটের সজ্জায় বর্ণিল। এ আয়োজন জাতীয় পাট দিবসকে ঘিরে। আজ ৬ মার্চ, জাতীয় পাট দিবস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ জাতীয় পাট দিবসের মূল অনুষ্ঠানে তিন দিনের পাটপণ্যের মেলা উদ্বোধন করবেন। ইপিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কাঁচা পাট, পাটের সুতা, পাটের বস্তাসহ সব ধরনের পাটপণ্যের রফতানি বেড়েছে আগের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ। রফতানি আয় হয়েছে ৫৮ কোটি ডলারের পণ্য। বর্তমানে ১১৮টি দেশে বহুমুখী পাটপণ্য রফতানি হচ্ছে। হস্তশিল্প হিসেবেও অনেক পণ্যে ব্যবহূত হচ্ছে পাট, যা পাটের রফতানি আয়ের মধ্যে স্বীকৃতি পায় না। দেশেও বাড়ছে পাটপণ্যের চাহিদা।
বছরে ৭০০ কোটি টাকার পাটের চট বা জিও টেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব বাংলায় পাট ছিল বৃহত্তম শিল্প। পাট দিয়েই বাংলাদেশকে চিনত বিশ্ব। স্বাধীনতার পরও পাট ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল ও রফতানি পণ্য। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাট থেকে। আশির দশকে সিনথেটিক পণ্যের ব্যবহার শুরু হওয়ায় পাট খাতের পতন শুরু হয়। কয়েক বছর ধরে আবারও বিশ্বব্যাপী পাটের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বিশ্ববাজারে। পাট ও পাটপণ্যের মোট রফতানি আয়ের ২০ শতাংশ জেগান দেয় সরকারি পাটকল। বাকি ৮০ শতাংশ আসে বেরকারি খাত থেকে। জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে ৭৬টি পাটকল ছিল এক সময়। এখন ৩টি নন জুটসহ সরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৬। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের পাটকলের সংখ্যা ১৭০টি। সরকারি পাটকলে লোকসান থাকলেও বেসরকারি খাতে মুনাফা বাড়ায় নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। নতুন পণ্য উদ্ভাবনে গবেষণাও চলছে। পাটের পলিথিন ব্যাগ, পোশাক উৎপাদন উপযোগী সুতার কাঁচামাল, পাটকাঠির ছাই থেকে প্রসাধনীর কাঁচামাল ও পাট পাতার চা উৎপাদন হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। সাধারণ খেলনা থেকে অত্যাধুনিক জেট বিমানে পর্যন্ত পাটের ব্যবহার হচ্ছে। অন্তত এক হাজার বহুমুখী পণ্য তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। বিশ্বব্যাপী বাজার বাড়ছে পাটপণ্যের। ২০১৯ সালের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ একই পথে যাচ্ছে। এর অর্থ, বিশ্বব্যাপী বাজার বাড়ছে পাটপণ্যের। গত তিন বছর ধরে পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষক। গত মৌসুমে এক মণ ভালো মানের পাটের দর বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১০০ টাকা। আগের মৌসুমের দর ছিল দুই হাজার টাকা। গত তিন বছর ধরেই ভালো দর পেয়েছেন কৃষক। কিন্তু কয়েক বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। এখন দর ভালো পাওয়ায় কৃষক আবার পাট চাষে ঝুঁকেছেন। উৎপাদনও বেড়েছে। ২০১৫ সালে পাটের উৎপাদন ছিল ৬৮ লাখ বেল।
২০১৬ সালে তা ৮৫ লাখ বেলে উন্নীত হয়। ২০১৭ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ লাখ বেল। আগামী ১০ বছরে পাটের উৎপাদন ২ কোটি বেলে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বিজেএমএর সহসভাপতি এবং খুলনার আফিল জুট মিলের এমডি এসকে আকরাম হোসেন সমকালকে বলেন, পাটে সরকারের মনোযোগ বাড়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এখন ভালো আছেন। প্রণোদনা বাড়িয়ে দেওয়ায় ভালো মুনাফা হচ্ছে তাদের। পুরনো বাজারে আরও মনোযোগ দিচ্ছেন তারা। নতুন বাজার তৈরিতেও কাজ চলছে। দুবাইভিত্তিক বাজার তৈরি হয়েছে গত বছর। চীনেও রফতানি হচ্ছে। ইইউতে আগামী বছর থেকে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে নতুন করে বাড়তি যে চাহিদা তৈরি হবে, তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন তারা। তার মতে, একটি পাটনীতি প্রণয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, আধুনিক মেশিনারিজ আমদানিতে সহযোগিতা পাওয়া গেলে এক বছরেই রফতানি আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব। গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, রফতানির পাশপাশি পাটের অভ্যন্তরীণভাবে সংরক্ষিত বাজার ধরে রাখতে হবে। সরকারি ক্রয়নীতিতে সড়ক নির্মাণে পাটের চট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে সড়ক যেমন মজবুত হবে, পাটের বাজারও বাড়বে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিজেএমসি থেকে নগদে পাট কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বিজেএমসির লোকসান কিছুটা কমবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের যে ঝোঁক তৈরি হয়েছে, পণ্যের মান উন্নয়নের মাধ্যমে তা কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য গবেষণা বাড়াতে হবে। ভারত সরকার বাংলাদেশি পাটপণ্যে বিভিন্ন হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক্ক আরোপ করায় দেশটিতে রফতানি প্রায় ৬০ শতাংশ কম হয়েছে। এ বিষয়ে উদ্যোগ প্রয়োজন।বহুমুখী পাটপণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের এমডি রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, এ খাতে বিপণন কৌশল ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিংয়ে ঘাটতি রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। পাট চাষে বীজের সংকটও প্রকট। ৯০ শতাংশ বীজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ নিয়ে আছে নানান জটিলতা। মানসম্পন্ন কাঁচামালের সংকট প্রকট। দেশে বিশেষায়িত জুট মিল নেই। নীতি সহায়তা বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক পণ্য রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পায়। কিন্তু পাটপণ্য এ সুবিধা পায় না। সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হলে আগামী ৭ বছর পর পাটপণ্য থেকে বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি উদ্যোগ : পাটের উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে আবার অর্থকরী হয়ে উঠছে পাট। পুনরুদ্ধার হচ্ছে রফতানি বাজার। লাভের মুখে চাষে ফিরেছেন কৃষক। আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে, দামও বেড়েছে। পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম সমকালকে বলেন, পাটের অর্থকরী মূল্য এমন হতে চলেছে যে, রাত জেগে ক্ষেত পাহারা দিতে বাধ্য হবেন কৃষক। পাটের উন্নয়নে সরকার বহুমুখী পাটজাত পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, রেল, সড়কসহ সরকারি বিভিন্ন বিভাগের টেন্ডারে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে জিও টেক্সটাইলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি কাজে ব্যবহারে পাটপণ্য ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান এখন পাটের তৈরি কাগজ, ফাইলসহ বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করছে। সরকার ১৭ পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। সরকারি পাটকলগুলোর আধুনিকায়নে চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিটিইএক্সআইসির কারিগরি সহায়তায় সরকারি ২৬টি কারখানার আধুনিকায়নের কাজ চলছে। পাটকলগুলোতে জরিপ চালিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে আধুনিক ও উন্নতমানের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে সক্ষম করে তোলা হবে। বাজার বহুমুখী করার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কৌশলগত বাণিজ্যিক অংশীদার হয়েছে গোল্ডেন ফাইবার অস্ট্রেলিয়া প্রাইভেট লিমিটেড (জিএফএপিএল) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ আরও ৬টি দেশে বাংলাদেশের পাটপণ্যের বাজার বাড়াতে সহায়তা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছরে ৪৫৪ কোটি টাকা মূল্যের পাটপণ্য নেবে অস্ট্রেলিয়া।
লোকসানে সরকারি পাটকল : বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান ড. মাহমুদুল হাসান সমকালকে বলেন, নানা কারণে দীর্ঘ দিন ধরে বিজেএমসির অধীনে কারখানাগুলো লোকসান গুনছে। গত অর্থবছরে লোকসান কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আগের বছরের ৬৫৬ কোটি টাকা থেকে গত বছর ৪৮১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা গেছে। লোকসানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থ সংকটে মৌসুমের শুরুতে কৃষকের কাছে থেকে ন্যায্য দামে পাট কেনা যায় না। পরে অপর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ ও ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বেশি দামে ফড়িয়াদের কাছ থেকে পাট কিনতে হয়।
কৃষিপণ্য ঘোষণা কার্যকর হয়নি : বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশেনের (বিজেএমএ) সচিব আবদুল বারিক খান সমকালকে বলেন, উচ্চ সুদের ব্যাংক ঋণ, ভারতীয় বাজারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক্কারোপসহ বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় কিছুটা সংকটে আছেন তারাও। তিনি বলেন, পাটকে কৃষিপণ্য ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গত ২ বছরেও তা কার্যকর হয়নি। কৃষিপণ্যের মর্যাদা পেলে পাটপণ্যও সব ধরনের কৃষিপণ্যের মতো ২০ শতাংশ রফতানি প্রণোদনা পেত। বর্তমানে বহুমুখী পাটপণ্য রফতানিতে প্রণোদনা রয়েছে ২০ শতাংশ। পাটের বাকি সব পণ্য যেমন- হোসিয়ান, সেকিং ও সিবিসি পণ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং পাটের সুতা রফতানিতে প্রণোদনা মাত্র ৫ শতাংশ। এ বছর পাট দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ'। পাট দিবসে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হবে। থাকবে দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের আয়োজন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাট দিবসের মূল আয়োজন উদ্বোধন করবেন। এ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেছেন, কৃত্রিম তন্তুর পরিবর্তে পাটের ব্যবহার পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণীতে বলেছেন, পাট থেকে পলিথিনসদৃশ পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব যে সোনালি ব্যাগ তৈরি হচ্ছে তা একদিন পৃথিবীজুড়ে সম্প্রসারিত হবে। পাট দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ৬ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনের পাটপণ্য মেলা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। ৭ মার্চ ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.