নদী রক্ষায় সামাজিক উদ্যোগ জরুরি by তুহিন ওয়াদুদ

৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটিতে তিন দিনব্যাপী নদীবিষয়ক সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ‘রিভারাইন পিপল’-এর পক্ষে আমি প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিলাম। ভারত, নেপাল, চীন, বাংলাদেশ ও ভুটানের নদী কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সম্মিলনে উপস্থিত ছিলেন। সরকারি পর্যায়ে নদী রক্ষায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকায় আইইউসিএনের (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়েছিল। সম্মিলনে উপস্থিত সবাই নদী রক্ষায় সুশীল সমাজের (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে সিএসও) ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নদী রক্ষায় সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই-এমন বক্তব্যই সম্মিলনে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে প্রেশার গ্রুপ ও অনুরোধকারী গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে সিএসও। আন্তসীমান্ত নদী রক্ষায় একটি বিষয়ে সবাই একমত, আন্তসীমান্ত রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে এই নদীগুলোর সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভারতে অন্যতম গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান আইআইটির (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) সিভিল ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক চন্দন মোহন্ত বলছিলেন, ব্রহ্মপুত্রের বন্যা ব্যবস্থাপনায় পাঁচটি দেশের সরকারকেই একযোগে কাজ করতে হবে। তা ছাড়া কার্যকর কিছু হবে না। বাংলাদেশ-ভারত-চীন-নেপাল-ভুটানের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক বড় সংকট দেখা দিতে পারে। চীন যদি ব্রহ্মপুত্রের পানি একতরফা প্রত্যাহার করে, তাহলে বাকি চারটি দেশের জন্য তা হবে ভয়াবহ। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানায় ব্রহ্মপুত্রে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে। তিস্তার প্রশ্নে ভারত সরকারের ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণমুখী নয়। সম্মিলনে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন পানিপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে অনেক বড় করে দেখানো হলো। কিন্তু নাগরিক সমাজের পক্ষে এত বড় চাপ সৃষ্টি করা কি সম্ভব? গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের অংশে ব্রহ্মপুত্রের অবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য সম্মিলনে উপস্থিত সবাই গিয়েছিলাম ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামে। আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে জানলাম সেখানে প্রায় পাঁচ মাস জলাবদ্ধতা থাকে। এই জলাবদ্ধতায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করে। বন্যার সময় এসব এলাকার জনগণ কোনো রকম ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসনের কোনো সহায়তা পায় না। ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনগণের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। অনেককে দেখলাম বাঁধের রাস্তার ওপর বাড়ি করে আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাদের ঘরবাড়ি নদীতে ভেসে যাওয়ার পর আর কোনো উপায় ছিল না। সেখানে অনেকের ঘর শণের তৈরি। তাদের পোশাক দেখেও আর্থিক সংকট টের পাওয়া যায়। যদি ব্রহ্মপুত্র নদ খনন করা যেত, তাহলে তাদের এই সংকট হতো না। বন্যার সময় তাদের জীবনে সীমাহীন দুর্যোগ নেমে আসে। অন্ন, বাসস্থান, যোগাযোগ-সব ক্ষেত্রেই তারা সংকট মোকাবিলা করে। সুপেয় পানির সংকট চরম আকার ধারণ করে। নারীদের জন্য সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি। চিমিনা গ্রামের শাহাদত নামের একজন জাহাজচালকের সঙ্গে কথা হয়। গ্রাম উন্নয়ন কমিটিরও সভাপতি তিনি। তাঁর কাছে জানলাম, ৪০ বছর তিনি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কলকাতায় জাহাজ চালানোর কাজ করেছেন। ব্রহ্মপুত্র তখন কেমন ছিল, এখন কেমন আছে-এ রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ব্রহ্মপুত্র আগে প্রস্থে অনেক কম ছিল। গভীরতা ছিল অনেক বেশি। বর্তমানে নদ প্রশস্ত হয়েছে, গভীরতা কমে গেছে। নদ খনন করা জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন। ভারতের কামরূপ অংশে দেখলাম ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্থ প্রায় ১০ কিলোমিটার। পর্যাপ্ত পানিও আছে। বাংলাদেশের অনেক স্থানে এই নদ প্রস্থে ২০-২৫ কিলোমিটার। ভারতের অংশে এত পানি থাকার পরও বাংলাদেশ অংশে পানি অনেক কমে এসেছে। আর মাসখানেক পর বাংলাদেশর অংশে ব্রহ্মপুত্র একেবারেই শুকিয়ে যাবে। ভারতের অংশে ব্রহ্মপুত্রে পানি আটকানোর কোনো বাঁধ না থাকার পরও বাংলাদেশের অংশে পানি না থাকার অন্যতম কারণ এই নদের বিচিত্র আচরণ। অন্যান্য সর্পিল নদীর মতো এই নদের বৈশিষ্ট্য নয়। এই নদে আছে প্রচুর চর। যতই ভাটিতে বয়ে গেছে, এই নদ ততই চরের ভেতর দিয়ে ভাগ হয়ে হয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ কারণে মূল স্রোত ক্রমাগত কমতে থাকে। অনেকগুলো আলাদা আলাদা স্রোতে ভাগ হতে হতে নদের মূল স্রোত যেমন কমে আসে, তেমনি একসময় নদটি প্রায় শুকিয়ে যায়। কেবল খনন করার পর একটি প্রধান প্রবাহ বজায় রাখতে পারলেই এই নদের পানির প্রবাহ ঠিক রাখা সম্ভব। আর এই কাজটি সম্পূর্ণ ব্রহ্মপুত্রের ওপর করতে হলে সংশ্লিষ্ট পাঁচটি দেশকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন শাহাদত হোসেনের মতো একই রকম কথা কিছুদিন আগে শুনিয়েছিলেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী অংশের বংশপরম্পরায় জেলে অভয়। তিনি বলেছিলেন, আগে নদ এখনকার চেয়ে কম প্রশস্ত ছিল, সারা বছর তখন পানি থাকত। এখন নদ বড় হয়েছে, কিন্তু পানি থাকে না, মাছও থাকে না। ব্রহ্মপুত্রের বুকে এখন শত শত চর। এই নদে একটি নির্দিষ্ট প্রবাহ বজায় রাখার জন্য চীন-নেপাল-ভুটান-ভারত-বাংলাদেশ পাঁচটি দেশকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পাঁচটি দেশের প্রতিনিধিরাই মনে করেন, সংশ্লিষ্ট সব দেশ এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে নদ রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু পাঁচটি দেশকে এক সিদ্ধান্তে আনার জন্য নাগরিক সমাজের ভূমিকার ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়ার কথা বলা হলো। সম্মিলনে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। উজানের দেশের একতরফা পানি প্রত্যাহার আইনসম্মত নয়। কীভাবে আইন মানতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাধ্য করানো যায়, তার ওপরও সম্মিলনে আলোকপাত করা হয়েছে। কোশি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে নেপাল-ভারত চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে উভয় দেশকে দায়ী করা হয়েছে। আসামের গুয়াহাটিতে তিন দিনব্যাপী সম্মিলনে নদী রক্ষায় নদীসংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করানো যায়, তার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে। নদীর পানিতে শুধু উজানের দেশের নয়, ভাটির দেশেরও অধিকার আছে। এই অধিকার বজায় রাখা জরুরি। উজানের দেশের দখলদারি মনোভাব দূর করাতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যাতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে পারেন, সে জন্য সুশীল সমাজকে নদী রক্ষায় সরব হতে হবে।
আসাম থেকে ফিরে
তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক
wadudtuhin@gmail. com

No comments

Powered by Blogger.