একটি পতাকা ও স্বাধীনতা by ডা. এমএ হাসান

আমাদের জাতীয় পতাকা তৈরির নেপথ্যের কথা অনেকের অজানা। মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ ও ইউসুফ সালাহউদ্দিন- এ দুজনের পরিকল্পনায় তৈরি হয় আমাদের জাতীয় পতাকা (১৯৬৯)। প্রথমজন তৎকালীন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৯-৭২) এবং দ্বিতীয়জন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় দুজন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলের ২০৪ নং কক্ষে বসে দেশ স্বাধীন করার বিষয়ে তারা আলাপ-আলোচনা করতেন। এখানে বসেই তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করেন (১৯৬৯)। এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তারা কেন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চিন্তা করেন? এ প্রশ্নের উত্তর হল- ঢাকা কলেজের ১৯৬৫-৬৭ ব্যাচের ছয়জন ছাত্রলীগ নেতা বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর সেকশনের এক জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একটি গোপন কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির সবাই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কমিটির সদস্যরা হলেন- ১. মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ (পরবর্তীকালে মৃত্তিকা বিজ্ঞানী), ২. চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার ইউসুফ সালাহউদ্দিন (পরবর্তীকালে প্রকৌশলী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), ৩. কুমিল্লার বরুড়া থানার মঈনুল ইসলাম চৌধুরী আজাদ (পরবর্তীকালে প্রকৌশলী, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী), ৪. চাঁদপুরের মতলব থানার ফিরোজ (পরবর্তীকালে প্রকৌশলী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), ৫. টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার আবদুল্লাহ সানি (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) এবং ৬. চাঁদপুরের মতলব থানার গোলাম ফারুক (পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ)। এ পতাকার চিন্তা করা হয় পাকিস্তানের পতাকাকে মানসপটে রেখে। পাকিস্তানের পতাকার কলাপাতা-সবুজ রঙের পরিবর্তে তারা বাংলাদেশের গাছ-গাছালির গাঢ় সবুজ বা বটল গ্রিন (কালচে সবুজ) রং দেয়ার চিন্তা করেন। সোনালি আঁশ পাট বা সোনার বাংলার কথা চিন্তা করে পতাকার চতুর্দিকে দুই ইঞ্চি পরিমাণ সোনালি রঙের বর্ডার দেয়ার চিন্তা করা হয়। পরবর্তীকালে তাদের চিন্তায় আসে, দামি সিল্কের কাপড় ছাড়া সোনালি রং হয় না এবং যেহেতু এটি সমগ্র দেশের পতাকা, সে জন্য গ্রামগঞ্জের মানুষের পক্ষে হয়তো এত মূল্যবান কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। এ চিন্তা থেকে তারা সোনালি রঙের বর্ডার দেয়ার পরিকল্পনা বাদ দেন। এরপর তারা পাকিস্তানের পতাকার চাঁদ তারার বদলে উদীয়মান সূর্যকে (যা লাল রঙের হয়) দিয়ে পতাকা তৈরি করেন। প্রসঙ্গত, জাপানের পতাকায়ও এ উদীয়মান সূর্য আছে। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ছাত্রলীগের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তক্রমে মনিরুল ইসলাম জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা তৈরির কথা বলেন। তখন এটি নিয়ে মিটিং করার সময় ছিল না। মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশের নেতৃত্বে পূর্ব প্রস্তুতকৃত পতাকার চিন্তা মাথায় রেখে কাপড় জোগাড় করার চেষ্টা করা হয়।
রাত বেশি হওয়ায় নিউমার্কেট তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিউমার্কেটের অ্যাপলো কাপড়ের দোকানের মালিক আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারে থাকতেন। মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক চিশ্তী শাহ হেলালুর রহমানসহ নায়ক খসরু, বদিউল আলম, একরাম, রায়হান, ফেরদৌস, মধু, জগন্নাথ কলেজের নজরুল, লিটল কমরেড রফিক প্রমুখ সেই দোকানের মালিককে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে এসে নিউমার্কেটের দোকান খুলে কাপড় জোগাড় করেন। এরপর বলাকা সিনেমা হলের তৃতীয় তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে পাক ফ্যাশন টেইলার্সে গিয়ে পতাকা সেলাই করা হয়। ওই পতাকা তৎকালীন ইকবাল হলে আনার পর ইউসুফ সালাহউদ্দিন লাল সূর্যের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকেন। এ সময় পতাকায় পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রকে সোনালি রং করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন জানা যায়, কুমিল্লার ছাত্রলীগ নেতা শিবনারায়ণ দাস সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অবস্থান করছেন, তিনি পেইন্টিং জানেন। মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশের নির্দেশে তখনই ঢাকা নগর ছাত্রলীগের নেতা ফজলুর রহমান বাবুল শিবনারায়ণ দাসকে সলিমুল্লাহ হল থেকে ডেকে নিয়ে আসেন এবং তাকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রের ওপর সোনালি রঙের পেইন্ট করা হয়। এই হল বাংলাদেশের পতাকা তৈরির নেপথ্য কাহিনী। ১৯৭০ সালের ৭ জুন ‘জয় বাংলা বাহিনী’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এ পতাকা তুলে দেয়। তিনি এ পতাকা গ্রহণ করে শেখ কামালের হাতে দেন এবং শেখ কামাল এটি তৎকালীন নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেনকে দেন।
যেভাবে উড়ল পতাকা
১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তখন সমগ্র ঢাকা শহর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হোটেল পূর্বাণীতে তখন আওয়ামী লীগের সংসদীয় সভা চলছিল। মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শেখ সেলিমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল হোটেল পূর্বাণীর দিকে এগিয়ে যায়। সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত এমসিসি বনাম পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েক হাজার লোক মিছিলে যোগ দেয়। জগন্নাথ কলেজ থেকে আতাউর, জাহাঙ্গীর ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল আসে। হোটেল পূর্বাণীর সামনে বিভিন্ন দিক থেকে আসা উত্তেজিত জনতা হঠাৎ পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সংসদীয় কমিটির সভা থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তোফায়েল আহমেদ এসে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরদিন ২ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সভা হয়। শেখ জাহিদ হোসেনের কাছে রক্ষিত পতাকাটি একটি বাঁশের মাথায় বেঁধে মিছিলকারীরা কলাভবনের দিকে আসে। মিছিলটি কলাভবনের দেয়ালের বাইরে উপস্থিত হলে ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতালি প্রদান করে এবং সমস্বরে বলে ওঠে, ‘ওই যে আসছে স্বাধীন বাংলার পতাকা’। সবার দৃষ্টি তখন পতাকার দিকে। সেই সময়ে মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যে ওই পতাকা আ স ম আবদুর রবের হাতে তুলে দেয়া হয়। সেই পতাকাটি হাতে নিয়ে আ স ম রব উঁচু করে নাড়তে থাকেন। এরপর ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে এটিকে স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ও প্রেসিডেন্ট হাউস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলিত হয়নি। সমগ্র দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা আরও কিছু পতাকা তৈরি করে। আজিমপুর কলোনির পানির পাম্প হাউসের ওপর এবং হাইকোর্টে সে পতাকা উড়ানো হয়। প্রবাসী সরকারের সময়ও এ পতাকা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার পটুয়া কামরুল হাসানকে দিয়ে এ পতাকা পুনর্বিন্যাস করেন। তখন থেকে কামরুল হাসান বাংলাদেশের পতাকার ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছেন (সূত্র : আমাদের জাতীয় পতাকার প্রকৃত ইতিহাস; মুহাম্মদ আসাদ, দৈনিক আমাদের সময়, ৪ জানুয়ারি ২০১০)। যারা সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং একতাবদ্ধ করেছেন। আর বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রত্যয়ী করে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করায় এবং স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান জানানোর কারণে স্মরণ করতে হবে মওলানা ভাসানীসহ অনেক নেতাকে। এ ক্ষেত্রে কমরেড মনি সিং, মোজাফ্ফর ও কমরেড ফরহাদের অবদান কম নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদকে বাদ দিলে তা অনেকটা ‘রাম ছাড়া রামায়ণ’ রচনা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি এবং নজরুল ইসলামই স্বাধীন বাংলা সরকার নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পার হয়েছেন। ভাষা আন্দোলনেও নজরুল ইসলামের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। এ দুই ব্যক্তির অসাধারণ নেতৃত্ব ছাড়া ৬ দফা আন্দোলন কখনোই সফলতা পেত না। স্বাধীনতা আন্দোলনে কামরুজ্জামানের ভূমিকা অত্যন্ত সক্রিয় ও উজ্জ্বল থাকায় তিনি পাকিস্তানিদের চোখে অন্যতম অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হন। সে কারণেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা রিপোর্ট ও শ্বেতপত্রে তার নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে। যারাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারাই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চোখে শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। জেল-জুলুম নেমে এসেছে তাদের ওপরই। হুলিয়া জারি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হত্যা করা হয়েছে তাদেরই। এ কারণেই সিরাজ সিকদার, কাজী জাফর ও মেননের মতো অনেক বাম নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হত্যা করা হয়েছে কর্নেল এমআর চৌধুরীকে। নির্যাতন নেমে এসেছে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও কর্নেল মাসুদের ওপর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণীদের কথা বলতে গিয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে যারা ভারত ভাগের পর ঐক্যবদ্ধ বাংলা তৈরির জন্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের। শ্রদ্ধা জানাতে হবে আবুল হাশিম, শরৎ বোস, শেরেবাংলা একেএম ফজলুল হক, আবুল মনসুর, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ তোহা, আবদুল মতিন (ভাষাসৈনিক), ধীরেন দত্ত প্রমুখ শ্রদ্ধাভাজন নেতাকে। ১৫ মার্চ কয়েকজন জেনারেল নিয়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে এলেন। এরা একদিকে নেপথ্যে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকল, অপরদিকে শেখ মুজিব ও অন্যান্য রাজনীতিকের সঙ্গে আলোচনা চালাতে লাগল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কালক্ষেপণ করে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করে অকার্যকরকরণ। এ সময় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজ ৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নেয়। পিআইএ বিমানযোগে অস্ত্র ও সৈন্য আনা হচ্ছিল। বেসামরিক পোশাকে যখন এ সেনা আনয়ন চলছিল তখন পিআইএ’র বিমান হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে দুই বাঙালি যুবক। সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এ সময় ঢাকা শহরের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ট্যাংক মোতায়েন করে পাকিস্তানিরা। এমনকি যে গণভবনে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলছিল সেখানেও ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। ইতিপূর্বে ৭ মার্চের সমাবেশে হামলার একটি প্রস্তুতিও নিয়েছিল পাকিস্তান বাহিনী। এ শঠতামূলক আলোচনার মধ্যেই চলে এলো ২৫ মার্চ।
ডা. এমএ হাসান : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ
dhasan471@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.