সিরিয়া সঙ্কটে কে দায়ী, কার কী স্বার্থ?

সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের শক্তিশালী ঘাঁটি পূর্ব গৌতায় ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদিত হলেও হামলা বন্ধ হয়নি। বোমাবর্ষণ চলছে, বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। শিশুরাও এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। যুদ্ধ বন্ধের আকুতি কারো কাছেই পৌঁছাচ্ছে না। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে।
বড় শক্তিধর দেশগুলো সেখানকার নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। দেশটি এখন পরিণত হয়েছে নানা শক্তির পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পথে নেমে পড়েছে রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, ইসরাইল, তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশ। মার্কিনি, রুশ, ইরানি, তুর্কি, কুর্দি, এমনকি বাশার আসাদের সরকার- সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের ব্যস্ত। এদের স্বার্থগুলো আবার অপরের বিপরীত। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আক্রমণ প্রতিরোধকারী সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুর্দিদের পিপলস্ প্রটেকশন ইউনিটকে (ওয়াইপিজি) সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াইপিজি সিরিয়ান কুর্দিশ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির (পিওয়াইডি) সশস্ত্র শাখা। ওয়াইপিজি সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশাল একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা একসময় আইএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই এলাকায়ই যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটিগুলো স্থাপন করেছে বলে অভিযোগ রাশিয়ার। ওয়াইপিজিকে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলো স্বায়ত্তশাসনের জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহরত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বর্ধিতাংশ বলে বিবেচনা করে আঙ্কারা। ওয়াইপিজির শক্তি বৃদ্ধিতে নিষিদ্ধঘোষিত পিকেকে আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠবে, এমন ধারণায় শঙ্কিত তুরস্ক সরকার। এই কারণে তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন আফরিন থেকে ওয়াইপিজির যোদ্ধাদের হটাতে সেখানে অপারেশন অলিভ অয়েল পরিচালনা করছে এরদোগান সরকার। অপরদিকে তুরস্কের সামরিক অভিযানের বিরোধী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কুর্দিদের আহ্বানে তুর্কি সেনাদের প্রতিরোধে তার অনুগত বাহিনীকে আফরিনে পাঠিয়েছেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আসাদকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া, ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ।সিরিয়ার গভীরে রাশিয়া এবং ইরানের অবস্থান পাকা, বাশার আসাদের বাহিনী নতুন নতুন এলাকা পুনরুদ্ধার করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক আসাদের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন দিলেও কুর্দি প্রশ্নে তারা এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে কুর্দিরা আইএসকে তাড়ানোর সময় আরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে - আর তাতে তুরস্ক উদ্বিগ্ন। তুরস্ক সিরিয়ান কুর্দিদের ওপর হামলা শুরু করেছে - যাতে তারা সরাসরি আমেরিকানদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। এর ফলে সিরিয়ার বাইরের শক্তিদের একটা সর্বগ্রাসী সংঘাতের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার প্রতি ইঞ্চি জায়গা মৃত্যুর হাতছানি দিচ্ছে।
এখানে শত্রু মিত্র পার্থক্য করা দুরহ ব্যাপার। সিরিয়া যুদ্ধ এখন আর সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের লড়াই নয়। এটি শুধু আসাদকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ নয়, আরো অনেক কিছু। ইসরাইলের অস্তিত্ব চিরকালের জন্য নিষ্কণ্টক করার যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আরেকবার ছুরি চালানোর যুদ্ধ। প্রতিনিয়ত শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে। মাঝখানে বলির পাঁঠা হচ্ছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণ। সিরিয়ার সঙ্গে ইরান, রাশিয়া, ইরাক, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক বেশ ভালো। সিরিয়াতে প্রচুর পরিমাণে সামরিক অস্ত্র রফতানি করে থাকে রাশিয়া, রয়েছে নৌ-ঘাঁটিও। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ ভালো। তুরস্ক নিজ জাতি ও স্বার্থগত কারণে বাসার-আল আসাদের বিরুদ্ধে। তুরস্ক ও রাশিয়া উভয়েই সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসনে তৎপর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজের বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তুরস্ক অনেক ক্ষেত্রেই সিরিয়াকে ট্রানজিট করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সিরিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য ইউরোপীয়ান দেশগুলো এতদিন অতটা আগ্রহী না থাকলেও এখন আগ্রহ বেড়েছে।

No comments

Powered by Blogger.