নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম by মো. মাহবুবুল বাসেত

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, মানুষের মধ্যে ততই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এ নির্বাচন যে শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম, তা মানুষ এর মধ্যেই আঁচ করতে পারছেন। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের অস্তিত্ব রয়েছে মারাত্মক হুমকির মধ্যে এবং সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ রয়েছে দল দুটির ‘ভয়ংকর টার্গেটে’। এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে- দেশ কি আরেকটি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে? ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের তিনটি নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা হয়। এগুলো হল- ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের চতুর্থ নির্বাচনে প্রধান বা বড় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেনি। দুর্বার আন্দোলনের মুখে এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে নিয়ে এ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজনও নির্বাচিত হননি।
দেশের সবাই জানে এবং এটাকে বলা হয় ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ নির্বাচনে প্রধান বা বড় বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেনি। দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ ও তার নেতৃত্বাধীন ফ্রিডম পার্টিকে নিয়ে এ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৯ জন নির্বাচিত হন। এটা দেশের সবাই জানে এবং এটাকেও বলা হয় ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বা বড় বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ করেনি। এ দুটি দল এ নির্বাচনের বিরুদ্ধে বা এ নির্বাচন ঠেকানোর জন্য দেশব্যাপী সহিংসতার মাধ্যমে ব্যাপক ও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরশাদ ও তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন- অন্য কোনো প্রার্থী না থাকায় বা ভয়ে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ায় এটাকেও বলা হয় ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। ফলে দেখা যাচ্ছে- এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার অধীনে দেশে তিনটি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়- যেগুলো ‘free, fair, acceptable, credible’ ছিল না। যদিও এই ‘free, fair, acceptable, credible’ শব্দগুলো দেশের সংবিধান বা জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২’-এর কোথাও নেই। শব্দগুলো হচ্ছে শুধু ‘নীতি ও নৈতিকতার’ পর্যায়ভুক্ত। আমাদের সংবিধান বা নির্বাচনী আইনে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের একমাত্র কাজ হচ্ছে ‘ভোটারদের জন্য নির্বিঘেœ ভোটদানের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা’,
যাতে তারা ও তাদের পরিবারের ভোটাররা ভোট দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন। সংবিধান বা নির্বাচনী আইনের কোথাও নেই-কয়টি দল নির্বাচনে এলে বা কত পার্সেন্ট ভোট পড়লে বা একেকটি নির্বাচনী এলাকায় কতজন প্রার্থী হলে সে নির্বাচন বৈধ বা গ্রহণযোগ্য হবে। যেমন ধরা যাক, একটি নির্বাচনী এলাকায় তিন লাখ ভোটার। ওই আসনে প্রার্থী যদি একাধিক হন এবং মাত্র তিনটি ভোট পড়ে, তাহলে বিদ্যমান নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে প্রার্থী দুটি ভোট পাবেন, তাকেই ওই আসনে নির্বাচিত ঘোষণা করা ছাড়া ওই এলাকার রিটার্নিং অফিসারের আর কোনো উপায় নেই। আর যদি ওই আসনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর্যায়ে রিটার্নিং অফিসার দেখেন একাধিক প্রার্থী নেই, তাহলেও রিটার্নিং অফিসারের তাকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা ছাড়া আইন অনুযায়ী আর কোনো উপায় থাকবে না। ৩০০ আসনেও যদি একাধিক প্রার্থী না থাকে, সব রিটার্নিং অফিসারকেই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও একমাত্র আইনগত দায়িত্ব হল রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফল গেজেটে প্রকাশ করা। তবে কোনো কেন্দ্রে গণ্ডগোল বা বিশৃঙ্খলার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেলে রিটার্নিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গেই ওই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দিতে পারেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অবস্থা কেন? এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে- আমাদের নির্বাচনী আইন ত্রুটিপূর্ণ এবং এসব ত্রুটি দূর করার জন্য আমাদের নেতানেত্রীরা বা সরকারগুলো কোনো উদ্যোগ নেন না। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, হানাহানি বা সংঘাত চলছেই এবং আইনের ত্রুটি দূর না করলে ভবিষ্যতে ‘নির্বাচনী সংঘাত’ এবং ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
আগামী নির্বাচনে তাহলে কী হবে
আগামী নির্বাচনেও অতীত পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা বেশি। কারণ দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলে দিয়েছে- শেখ হাসিনার অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। আরেকটি বড় দল জামায়াতে ইসলামীও এ ইস্যুতে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। কারণ দল দুটিকে হয় শেখ হাসিনার সঙ্গে সমঝোতায় এসে নির্বাচনে যেতে হবে, আর না হয় পরিকল্পিত বা অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ঠেকাতে হবে। অন্যথা তাদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে এবং দল দুটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারাবে বা হারাতে পারে। শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ কোনোরকমে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারলে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে আইনগত প্রক্রিয়ায় দল দুটির নিবন্ধন বাতিল করাবে। কারণ দল দুটি গত সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেনি। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ‘কোনো নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দল ‘পর পর দুইবার’ (consecutive terms) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন কমিশন সে দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রাখে। ফলে এটা অনায়াসেই বলা যায় যে, আগামী নির্বাচন হবে বিএনপি ও জামায়াতের টিকে থাকা বা অস্তিত্ব রক্ষার নির্বাচন এবং এ কারণেই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার থাকবে বড় ধরনের টার্গেটে এবং সঙ্গত কারণেই যেহেতু ২০১৪ সালের মতো আরেকটি কথিত ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের সম্ভাবনা বেশি, তাই ‘সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির আশঙ্কা’ উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মো. মাহবুবুল বাসেত : সিনিয়র সাংবাদিক, সংসদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.