মিয়ানমার সীমান্ত নীতির বরখেলাপ করেছে by এম হাফিজ উদ্দিন খান

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের ওপারে হঠাৎ ভারী অস্ত্র ও অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে প্রকাশ, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) পোশাক পরে তাদের সেনা সদস্যরা সীমান্ত আইন ভেঙে সীমান্তের আশপাশ এলাকায় কৌশলে অবস্থান নেয়। আমরা অবশ্যই বলব, এমন কর্মকাণ্ড মিয়ানমারের স্পষ্টতই হঠকারিতা। মিয়ানমারের এ ধরনের হঠকারী ও উস্কানিমূলক আচরণে তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান করা প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা ও সীমান্তের এপারের মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সে দেশের রাষ্ট্রশক্তির বর্বরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতার শিকার হয়ে। তারা এক কথায় সর্বহারা। ভিটে-মাটি, স্বজন-সম্পদ- সব হারিয়েছে তারা। তাদের অস্তিত্ব বিনাশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রশক্তি ইতিমধ্যে যেসব জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে বিশ্বের ঘৃণ্য নজির হয়ে আছে। নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় সীমান্তের ১৫০ গজ অভ্যন্তরে মিয়ানমারের সৈন্য ও সমরাস্ত্র সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়কে নানা দিক থেকে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের তরফে ইতিমধ্যে এ জন্য ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পতাকা বৈঠক হলেও সেনা সরানোর দিনক্ষণ জানায়নি মিয়ানমার। এর আগে গণমাধ্যম মারফতই জানা গিয়েছিল, বেশ কয়েক দিন ধরেই সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না ঢুকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য দরজা খুলে দিয়ে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের নানামুখী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কতটা শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছে- এ নিয়ে নানা মহলে কথা আছে। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে মিয়ানমারেরই সুবিধা হয়েছে- এমন কথাও আছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে এ কথা সত্য যে, এসব ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা বাংলাদেশের মানবিকতা প্রদর্শনের জন্য প্রশংসা করার পাশাপাশি এ কথাও বলেছে, তারা বাংলাদেশের পাশে আছে। তবে এ কথাটি আবারও বলি যে, বাংলাদেশের অবস্থান মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আরও শক্ত হতে হবে। সম্প্রতি নোবেলজয়ী তিন নারী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। সেখানকার নোম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে সেখানেও এই মহীয়সী নারীরা গিয়েছিলেন। এর পরই সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠা মিয়ানমার সেনাদের হুমকি-ধমকিতে সীমান্তে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মিয়ানমার সীমান্তে ভারী অস্ত্র মোতায়েন ও সেনা সমাবেশ করে সীমান্ত নীতির স্পষ্ট বরখেলাপ করেছে।
আমাদের স্মরণে আছে, এর আগেও মিয়ানমার একাধিকবার ছোটখাটো ও তুচ্ছ ঘটনায় সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোসহ নানা ধরনের উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। সম্প্রতি নোবেলজয়ী তিন নারী সীমান্ত সফর করে মন্তব্য করেছেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি করা উচিত। বিশ্ব সম্প্রদায় থেকেও মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য ইতিমধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। হঠাৎ মিয়ানমারের তরফে সীমান্তে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় বাংলাদেশও সীমান্তে অবস্থান শক্ত করেছে এবং পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বলে বলা হয়েছে। শূন্যরেখা থেকে প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণার পর মিয়ানমার যে ভূমিকা নিল তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, এ ব্যাপারে আমাদের নতুন করে ভাবনার বিষয়ও দাঁড় করিয়েছে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক নীতি অমান্য করে আবারও প্রমাণ করেছে- তারা নানারকম অপকৌশলে এখনও লিপ্ত। সন্দেহ নেই, দেশটির সেনাপ্রধান ও সেনা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্ব জনমতের দৃঢ়তায় কিছুটা হলেও ভীত-সন্ত্রস্ত। এ ব্যাপারে তারা তাদের অন্য অবস্থান বোঝানোর জন্যও এমনটি করে থাকতে পারে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের প্রশাসন যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো মেনে নিতে পারছে না মিয়ানমারের সেনা প্রশাসন- এমন কথাও রয়েছে। আমার মনে হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টির দিক থেকে দৃষ্টি সরানোর পাশাপাশি তারা তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিতেই এমন কাজ করেছে। আবারও বলি, তাদের এ ধরনের পদক্ষেপ স্পষ্টত হঠকারিতা ভিন্ন কিছু নয়। তাদের এমন হঠকারিতার জবাব হলো আমাদের দৃঢ় অবস্থান। তাদের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহল নিশ্চয়ই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে, বাংলাদেশের তরফে বিশ্ব কূটনীতি আরও জোরদার করে বিশ্বদরবারে এ ব্যাপারে নতুন কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। মিয়ানমার বারবার সীমান্তে সৈন্য ও ভারী সমরাস্ত্র বাড়িয়ে তাদের যে অবস্থান তুলে ধরছে- এর বিপরীতে বাংলাদেশেরও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সঙ্গে। এটা তো অনস্বীকার্য- রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট ভিন্ন এবং তা মিয়ানমারের অনুকূলে নয়। বরং এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের যথেষ্ট ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশকে এটুকু কাজে লাগাতে হবে। সীমান্তে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি মিয়ানমার বারবার করছে; এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে বাংলাদেশ অক্ষম নয়- তা আরও স্পষ্ট করে দিতে হবে। বাংলাদেশের শক্তি ও সক্ষমতার বিষয়টি আরও পরিস্কারভাবেই তুলে ধরা উচিত।
সার্বিক পরিস্থিতির দিকে আরও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেন অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে না পারে, এ জন্য থাকতে হবে সজাগ। কোনো উস্কানিতে বিচলিত না হয়ে বরং অতীতের মতো ধৈর্য ও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার সুচারুভাবে। রোহিঙ্গা সংকটের দায় মিয়ানমারের- এটা সচেতন বিশ্ববাসীর অজানা কোনো বিষয় নয়। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে সে দেশে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। এ অবস্থা থেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি মিয়ানমার অন্যদিকে ফেরানোর যত চেষ্টাই করুক না কেন, তা সফল হবে বলে মনে হয় না। অস্ত্রের ভাষায় মিয়ানমার কথা বলার পুনর্বার যে হীন চেষ্টা করছে, তা ঘৃণ্য। রাখাইনে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে পৈশাচিক শক্তি হিসেবে। সভ্যতা-মানবতার এমন দলন-পীড়ন ঘটিয়ে বর্তমান জামানায় কোনো রাষ্ট্রশক্তিই পার পেতে পারে না। মিয়ানমারের রাষ্ট্রশক্তি আর কত নিষ্ঠুরতা-বর্বরতা-পৈশাচিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে? তারা কি আধুনিক বিশ্বের কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না? তাদের যারা নানাভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে কিংবা প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদেরও ভাবনায় পরিবর্তন ঘটানো উচিত। শান্তির পথ মিয়ানমার আর যেন কণ্টকাকীর্ণ না করতে পারে- বিশ্ব সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আমরা শান্তির পক্ষে। শান্তিপূর্ণ পন্থায় সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও আমাদের রয়েছে। কাজেই উস্কানির পথ মিয়ানমারের পরিহার করাই শ্রেয়। মিয়ানমার বলেছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে তমব্রু সীমান্তের ওপারে রাখাইনে তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে; বাংলাদেশ তাদের লক্ষ্য নয়। এ যুক্তি ধোপে টেকে না। মিয়ানমারের নানা রকম অজুহাত সৃষ্টির পেছনে কোন হীন উদ্দেশ্য নিহিত, তা পর্যালোচনা করা দরকার। আন্তর্জাতিক সীমান্তের আট কিলোমিটারের মধ্যে কোনো দেশের সেনা মোতায়েন বা সেনাবাহিনীর চলাচল হলে সে ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী অন্য দেশকে অবহিত করতে হয়। সীমান্ত নিয়ে এই আন্তর্জাতিক সনদ বিষয়ে নিশ্চয়ই মিয়ানমার অজ্ঞাত নয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন না করে মিয়ানমার সীমান্তে যে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাংলাদেশকে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.