জন্মগত ত্রুটি রোধে সচেতনতা বাড়ুক

বাংলাদেশে কতজন শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক তাহমিনা বানুর নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালে এই বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ৪৫ শতাংশ শিশু জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত (সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০১৫)। উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রতি ১০০ শিশুর ৩ থেকে ৬ জন বড় ধরনের জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত এবং এই সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালের ৩ মার্চ ‘বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস’ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি ১০ জনে একের অধিক নবজাতক শিশু জন্মগত ত্রুটিজনিত কারণে মারা যায়। জন্মের সময় যদি শিশুর দেহের কোনো অঙ্গ অনুপস্থিত বা ত্রুটিপূর্ণ থাকে, তাহলে তাকে জন্মগত ত্রুটি বলে। এটি শরীরের গঠনগত, কার্যগত, মেটাবলিক বা জেনেটিক অসামঞ্জস্য যা ভ্রূণ অবস্থাতেই উৎপন্ন হয়। জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই। বেশির ভাগ সময়ে মাকেই শিশুর জন্মগত ত্রুটির জন্য দোষারোপ করা হয়। অনেকে এর কারণ হিসেবে গর্ভকালীন সূর্যগ্রহণ/চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব, খাবার খাওয়ার ফল, মানুষের কুনজর, জিন-পরির আসরকে দায়ী মনে করে। এখন পর্যন্ত জন্মগত ত্রুটি সম্পর্কে যেসব কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বংশগত, জিনগত, রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ, খুব কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি, গর্ভকালীন ধূমপান ও মদ্যপান, সংক্রামক রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, খিঁচুনি, অপচিকিৎসা, তেজস্ক্রিয়তা, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন ইত্যাদি। গর্ভধারণের আগেই মা-বাবার পূর্ব ইতিহাস জেনে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ভ্রূণের প্রথম ১২ থেকে ২২ সপ্তাহে ‘হাই রেজল্যুশন আল্ট্রাসনোগ্রামের’ মাধ্যমে বেশির ভাগ ত্রুটি বোঝা যেতে পারে। তাই এই সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করানো উচিত।
এ ছাড়া জিনগত সমস্যা শনাক্ত করতে রক্ত পরীক্ষা এবং ‘অ্যামনিওটিক ফ্লুইড অ্যানালাইসিস’, ‘কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পল অ্যানালাইসিস’ ইত্যাদি এখন বাংলাদেশেই সম্ভব। আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ জন্মগত ত্রুটিজনিত রোগের বোঝা সার্জিক্যাল সেবার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে এসব শিশুকে অকালমৃত্যু বা দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং এসব শিশু সমাজের জন্য বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়। জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো রক্তসম্পর্কীয় বিবাহ না করা, খুব কম বা বেশি বয়সে মা না হওয়া, গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, পরিকল্পিত উপায়ে জন্মদান, গর্ভকালীন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে বিরত থাকা, মদ্যপান না করা, ‘অ্যানোমালি স্ক্যানিং’ করা, মাতৃত্বকালীন সেবার মান উন্নয়ন, অপুষ্টি দূরীকরণ ইত্যাদি। জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, যথাযথ কারণে গর্ভপাতের আইন প্রণয়ন করা, ত্রুটিযুক্ত শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করা ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। এ ছাড়া শিশুদের সার্জিক্যাল সেবা সাশ্রয়ী করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে যেসব জন্মগত ত্রুটি নিরাময়যোগ্য তা উল্লেখযোগ্যভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব। জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা শুধু শিশুটিকে সমাজের কর্মক্ষম ব্যক্তিতে পরিণতই করে না, তার পরিবারকেও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বাঁচায়। দ্য ল্যানসেট কমিশন অন গ্লোবাল সার্জারি এবং দ্য ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লি রেজল্যুশন ৬৮ দশমিক ১৫-এর মাধ্যমে সার্জিক্যাল ব্যবস্থাকে সারা বিশ্বে শক্তিশালী করার ভিত্তি স্থাপন করা হয়। কিন্তু এতে শিশুদের সার্জারি গুরুত্ব পায়নি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৩ দশমিক ২ লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু প্রতিরোধ করা। শিশুদের সার্জারির জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়া এ লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। সমগ্র বিশ্বের শিশুদের সার্জিক্যাল সেবা প্রদানকারীদের নিয়ে ২০১৬ সালে গঠিত হয় দ্য গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর চিলড্রেন সার্জারি (জিআইসিএস)। তারা একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শিশুদের নিরাপদ সার্জিক্যাল সেবার লক্ষ্যে গাইডলাইন তৈরি করেছে। এখন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে ভৌগোলিক বা আর্থসামাজিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, সব শিশু যেন সুলভে, সময়মতো সার্জিক্যাল সেবা পায় তার বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়ন।
(তাহমিনা বানু, নওরীন তামান্না, অর্ণি দাস, তাহমিয়াহ্ তাহেরা আজিজ, নুগায়ের শারমিন: লেখকেরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক)

No comments

Powered by Blogger.