কামান দাগালেও মশা কেন মরে না? by মীযানুল করীম

‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি’। ২০০ বছর আগের কলকাতায় শুধু রাতে মশায় কামড়ালেও বর্তমান ঢাকায় দিনের বেলায়ও মানুষের রক্ত পানে মশককুলের নেই কোনো অরুচি। তাই তো পত্রিকার খবর, রাজধানীর অনেক দোকানপাটে পর্যন্ত দিনভর কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয় মশার জ্বালায়। আগে মশার কামড়ে কেবল ম্যালেরিয়ার ভয় ছিল, এখন আতঙ্ক ডেঙ্গু ছাড়িয়ে চিকুনগুনিয়ারও।
এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশেও জিকা ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কি না, এই ভীতি অমূলক নয়। মহানগরীর ঢাকায় মশাবাহিনীর সর্বত্র অব্যাহত ও বেপরোয়া হামলার মুখে সিটি করপোরেশন দুটোর ‘শীতনিদ্রা’ শেষ হয়েছে শীত বিদায় নেয়ার বেশ কিছু দিন পরে। এত দিনে দেখা যাচ্ছে, মেয়রবিহীন উত্তর সিটি মশক নিধনের ব্যাপারে হটলাইন এবং মেয়রসমৃদ্ধ দক্ষিণ সিটি ক্র্যাশপ্রোগ্রাম চালু করার খবর একসাথে এসেছে পত্রিকায়। ঠিক সে দিনই ঢাকা শহরের পরীবাগে অনুষ্ঠানমঞ্চ ‘ক্র্যাশ’ করে পড়ে যাওয়ার আগে দক্ষিণের মেয়র ঘোষণা দিলেন, ‘চিকুনগুনিয়াকে ঝাঁটা দিয়ে বিদায় করতে চাই’। অবশ্য এর আগে রাজধানীর সর্বত্র ঝাঁটা দিয়ে আবর্জনা বিদায় করা হলে মশাবাহিত এ রোগের শঙ্কা অনেক কমে যাবে। আমরা আশা করি, অন্তত এসব রোগের প্রকোপ বন্ধ করার স্বার্থে হলেও মশা মারার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে এখন থেকেই। দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বৃহস্পতিবারের ওই সভায় সবার প্রতি আবেদন রেখেছেন, ‘এপ্রিলে আগাম বৃষ্টি হলে আঙ্গিনা ও ফুলের টব পরিষ্কার রাখুন।’ অবশ্য এপ্রিলের আগেও বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তাহলে কী করণীয়, সেটাও বলা উচিত ছিল। মেয়র বলেছেন, ‘চিকুনগুনিয়া মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত।’ কিন্তু সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান নয়, যদিও দুই মাস ধরে মশার উপদ্রব বাড়ছে। শুধু ওষুধ ও সরঞ্জাম স্টক করে রাখার নাম ‘প্রস্তুতি’ নয়।
বরং মশার প্রজননস্থলে নিয়মিত মানসম্মত ওষুধ ছিটালেই মানুষ আশ্বস্ত হতে পারে। মশা মারার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অন্য দিকে উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি) বরাদ্দ রয়েছে ২০ কোটি টাকা। খোকনের ঘোষণামাফিক, গত বুধবারই দক্ষিণ সিটির সর্বত্র ক্র্যাশপ্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা। তিনি দাবি করেন, ওষুধ কেনা নিয়ে আগে যেসব অভিযোগ উঠত, তা আর নেই। অথচ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই বলছেন, মশার ওষুধ ছিটালেও তেমন ফল পাওয়া যায় না।’ দেখা যাক, কোটি কোটি টাকার ক্র্যাশপ্রোগ্রামে নগরীর মশাকে কতটা ক্র্যাশ (ধ্বংস) করা যায়। এ দিকে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে মশার ওষুধের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দৈনিক সমকালের খবর মোতাবেক, দক্ষিণ সিটিতে মশার ওষুধ সংরক্ষণ করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। অন্য দিকে উত্তর সিটিতে এই ওষুধ দিয়ে দেয়া হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে। আসলে ওষুধ কেনায় মহাদুর্নীতি আর সংরক্ষণ ও ছিটানোর বিরাট অনিয়মের যে অভিযোগ, তার সুরাহা না হলে মশা মারতে কামান দাগালেও মশা মরবে না। ‘মশা’র সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সংসদ বাংলা অভিধানে- ‘দংশনকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গবিশেষ’। তবে পতঙ্গটি ক্ষুদ্র হলেও এটি গোটা দেশ ও জাতির জন্য বিরাট বিপদের কারণ হতে পারে। মশারির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। মশার ‘অরি’ বা শত্রু হলো মশারি। তবে কোনো কোনো সময় তা অপরিণামদর্শী মানুষেরও ‘অরি’ বা শত্রু হয়ে উঠতে পারে। রাতে শুয়ে ধূমপান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ায় মুখের সিগারেটের আগুনে মশারি পুড়ে মহাবিপদ ডেকে আনার নজির আছে। অতীতে আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই মহামারী দেখা দিত। এতে বহু লোক মারা যেত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা প্রভৃৃতি রোগে শত শত মানুষ প্রাণ হারাত। ম্যালেরিয়ার মড়ক ঠেকাতে একপর্যায়ে মশা দমনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হলো ম্যালেরিয়া নির্মূল করার ভিন্ন সংস্থা। এটি চালু ছিল পাকিস্তান আমলের শেষভাগ পর্যন্ত। একসময় সরকার ‘নিশ্চিত’ হলো, দেশে আর ম্যালেরিয়ার আশঙ্কা নেই। অতএব, দফতরটি তুলে দেয়া হলো। গত কয়েক দশকে ম্যালেরিয়া বিশেষ করে দেশের সীমান্ত এলাকায় ফিরে এসেছে। কিন্তু ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের সেই বিশেষ প্রতিষ্ঠান আর নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা সীমান্তের ওপার থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। নিকটাতীতে পার্বত্যাঞ্চলে প্লান্টেশনের মালিক একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মেয়ের মৃত্যুর কারণ ম্যালেরিয়া বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে পড়েছি, মশা তিন প্রকার- অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স ও স্টেগোমিয়া। যথাক্রমে ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়া (গোদ) রোগের উৎস হলো অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশা। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে গোদ রোগের ব্যাপক প্রকোপ আজো একটি মারাত্মক সমস্যা। অন্য দিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পার্বত্য ও বনজঙ্গলপূর্ণ এলাকায় ম্যালেরিয়ার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশা ম্যালেরিয়া ছাড়াও ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ারও কারণ। বাস্তবতা হলো, খোদ রাজধানীতেই মশার উপদ্রব অতীতের মতো অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো সময় তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। অথচ মশা দমনের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে এবং বিভিন্ন এলাকায় যন্ত্রের প্রবল গর্জনের সাথে ওষুধ ছিটাতেও দেখা যায়। ঢাকায়ই যদি মশার তাণ্ডব চলে অবাধে, তা হলে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদে ‘মশার রাজত্ব’ কতটা দোর্দণ্ড প্রতাপে চলছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মশা থেকে রক্ষা পেতে এখনো দেশের জনগণের বিরাট অংশ কয়েল ব্যবহার করে থাকে। একাধিক কোম্পানির কয়েল বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কারো কারো কয়েলের বিজ্ঞাপনী চমকে মনে হয়, এই কয়েলে অবশ্যই মশা মারা পড়বে এবং এর ব্যবহারে মানুষ বা পরিবেশের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয় না। আসলে মশা মারার কয়েলের কার্যকারিতা যেমন কমেছে, তেমনি এর ক্ষতিকর প্রভাব অনস্বীকার্য। নামী-দামি প্রতিষ্ঠানের স্প্রে দিয়েও আজকাল বেশি সুফল মেলে না। আর এতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান তো থাকেই। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন, বিড়ি-সিগারেট মাত্রই মারাত্মক ক্ষতিকর জিনিস। এর মধ্যে একসময় চালু হলো ফিল্টার লাগানো সিগারেট। প্রচার করা হলো, এটি তামাকের নিকোটিনের ক্ষতি থেকে বাঁচায়। পরে গবেষণায় দেখা গেল, ‘যাহা বাহান্ন, তাহাই তেপ্পান্ন’। এর মানে, সিগারেট সেবনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়, ফিল্টার থাক বা না থাক। তেমনি কয়েল ও স্প্রে ব্যবহারে হয়তো মশা কিছু কমে, কিন্তু মানবদেহ ও পরিবেশের ক্ষতি সে তুলনায় অনেক বেশি। এ অবস্থায় মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, তথা এর জন্মের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া নিশ্চিত করাই এখন করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বেশির ভাগ সময় দেশের অনেক জনপদে মশার হদিস পাওয়া যেত না। কারণ প্রখ্যাত জননেতা মরহুম হাবীবুল্লাহ বাহার স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে তুরস্ক থেকে কড়া ওষুধ আনিয়ে তা ছিটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মশার এই ওষুধ ডোবানালায় শুধু নয়, গ্রামের বাড়িঘরেও দেয়া হয়েছিল। এ ওষুধের প্রভাবে ঘরের বেড়া কয়েক বছর ধরে সাদাটে হয়ে গিয়েছিল। স্মর্তব্য, হাবীবুল্লাহ বাহার (১৯০৮-৬৬) একাধারে রাজনীতিক, সাহিত্যিক এবং প্রথম জীবনে বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কবি নজরুলের স্নেহধন্য বাহার সাহেব ১৯৪৭ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তখনো দেশের গ্রামাঞ্চলে ম্যালেরিয়া মহামারীতে বহু লোক মারা যেত।
এ অবস্থায় তিনি মশা দমনের কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু খাঁটি ওষুধ যথাযথভাবে প্রয়োগের সে উদ্যোগ পরে আর অব্যাহত ছিল না। ফলে ‘মশকবাহিনী’ আবার তার ভয়াবহ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। হাবীবুল্লাহ বাহার মন্ত্রী হওয়ার পর পত্রিকায় একটি বিখ্যাত চুটকি ছাপা হয়েছিল। ঢাকা শহরেও মশার দাপট। মিডিয়াব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীর উদ্যোগে সেই সময় বের হতো ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী ‘অগত্যা’। একই সময়ে বলিউডের একটি রোমান্টিক গানের কলি ছিল ‘পুছো বাহার ছে’ (বসন্তকালকে জিজ্ঞাসা করো)। ‘অগত্যা’ এই ‘বাহার’কে মন্ত্রীর নাম হিসেবে ব্যবহার করার চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছিল। তাদের চুটকিটা ছিল এরকম : (প্রশ্ন) ঢাকায় মশার উৎপাত কমবে কখন? (উত্তর) পুছো বাহার ছে। যা হোক, কথা হচ্ছে- বাহার সাহেব মন্ত্রী থাকার সময় মশার বংশ অনেকটাই ধ্বংস করা গেলে এরপরের ছয় দশকেও কেন তা সম্ভব হলো না? অথচ এর মধ্যে কত মন্ত্রী এলেন, গেলেন। ঢাকা শহর মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এখন মেগাসিটি; মেট্রোপলিটনের পর্যায় পেরিয়ে কসমোপলিটান হতে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা পানিতে ঢেলে ফাঁকা কামান দাগা হচ্ছে, তবুও মশা দমছে না বা কমছে না। উন্নয়নের জোয়ারের যুগেও এ অবস্থার উন্নতি হয়নি কেন? ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, মশার ওষুধ ছিটানোর ক্ষেত্রে অনেক বড় অনিয়ম ঘটছে। এই ওষুধ দিতে হয় বিশেষ করে প্রজননস্থলে; ছিটাতে হয় বছরের উপযুক্ত সময়ে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে। মশার ওষুধ একই দিনে দু’বার প্রয়োগ করাই নিয়ম। একবার ভোরে ও সকালে দিতে হয় মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য। আবার বিকেল বা সন্ধ্যায় দিতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক মশা মারার জন্য। সর্বোপরি মশার ওষুধের গুণগত মান অবশ্যই হতে হবে যথাযথ। এ জন্য ওষুধ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা এবং মানসম্মত না হলে সে ওষুধ ‘লোকদেখানো’র জন্য ব্যবহার না করা জরুরি। বাস্তবে এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কতটুকু সচেতন, তার সাক্ষ্য দিচ্ছে রাজধানীর মশক পরিস্থিতি।
পাদটীকা: একটি ছড়ায় বলা হয়েছে, ‘নগরবাসী অতিষ্ঠ আজ/যায় না করা ঠিকমতো কাজ/বাড়ছে মশার উৎপাত/নড়ছে নাকো টনক কারো/কী এসে যায় বাজলে বারো/খাচ্ছে তারা দুধভাত।/ওষুধগুলো নষ্ট-অচল/মেশিনগুলোও হয় না সচল/বরাদ্দ কম অর্থ/অনিয়ম আর অবহেলা/যুক্তি নিয়ে করছে খেলা/দিচ্ছে নানা শর্ত/ছুটলে মশা দিনে রাতে/কাজ হবে না কিছুই তাতে/দিক না যতই যুক্তি/নগরবাসী জাগতে হবে, প্রয়োজনে রাগতে হবে/মিলবে তাতে মুক্তি।’

No comments

Powered by Blogger.