কেএম এটিএম হবেন না কাজী রকিব? by সোহরাব হাসান

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনই আমরা হতাশ হতে চাই না। প্রত্যাশা রাখতে চাই অতীতের ব্যর্থতা ও গ্লানি ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ১৯৭০ সালের অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। পাকিস্তানি শাসকেরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বলেই একাত্তরের এই মার্চে বাঙালি অস্ত্র হাতে নিয়েছিল।
তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আশার কথা বলার আগে লজ্জার কথাটি বলে নিতে হয়। প্রথম লজ্জাটি নিজের পেশার। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০ জন প্রার্থী। তাঁদের দাবি, নির্বাচনে জাল ভোট হয়েছে, হঠাৎ ভোটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের পরও এক ঘণ্টা ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। জাল ভোট দিতে এসে ৩০ জন হাতেনাতে ধরা পড়লেও নির্বাচন কমিশন রহস্যজনক কারণে তাঁদের ছেড়ে দিয়েছে ইত্যাদি। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ আগে শোনা যায়নি। সেদিন ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম, প্রেসক্লাব অঙ্গন ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। শত শত লোক ভোটের প্রচারে ব্যস্ত (সবাই সাংবাদিক নন)। ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখে কয়েকজন সহকর্মী ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছেন। একজন সাংবাদিক বন্ধু সখেদে বললেন, ‘ঢাকা শহরে এত সাংবাদিক আছেন তা জানা ছিল না।’ ১০ জন প্রার্থী পুনর্নির্বাচনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কি হয়নি সেই বিতর্কে না গিয়েও বলব খবরটি পড়ে সংবাদকর্মী হিসেবে আমি লজ্জিত। দ্বিতীয় লজ্জার ঘটনা হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হাতাহাতির কারণে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ভোট গণনা স্থগিত হয়ে যাওয়া। সমিতির নির্বাচন হয় ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১ মার্চ রাত ১১টা থেকে ভোট গণনা শুরু হলে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় একজন সভাপতি প্রার্থীসহ ২ জন আহত হয়েছেন এবং চিকিৎসার জন্য তাঁদের হাসপাতালে নিতে হয়েছে। অভিযোগ, ভোট গণনার সময় বহিরাগতরা এসে ঝামেলা পাকিয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে লজ্জার ঘটনা আরও আছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে এখন সরাসরি নির্বাচন হয় না। পরোক্ষ ভোটে নেতা নির্বাচিত করা হয়।
অনেকটা আইয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্রেসির’ মতো। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, রিহ্যাবের কমিটি মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক কারা হবেন, তা আগেই ঠিক করে দেওয়া হয়। এরপর সরকারের পছন্দের একজনকে বেছে নেওয়া হয় এফবিসিসিআই সভাপতি হিসেবে। সব সরকারের আমলে এই ধারা চলছে। জেলা শহরগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হন। সম্ভবত জাতীয় নির্বাচনের কালো ছায়া পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ওপর পড়তে শুরু করেছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সামনে যেই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে পারব কি না? একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ যে কার্যকর হয় না, সেখানে বিরোধী দলের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না, তার প্রমাণ বর্তমান সংসদ। এত দিন গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের প্রতনিধিরা কথাটি চিৎকার করে বললেও সংবিধানের রক্ষকেরা তা আমলে নেননি। এখন সেই সংসদের খোদ ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ রওশন এরশাদ বলতে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টি পরিচয় সংকটে আছে। এটি শুধু দলের সংকট নয়, গণতন্ত্রেরও সংকট। যেকোনো নির্বাচনের অর্থই হলো প্রতিনিধি বাছাইয়ের অবাধ সুযোগ। আর সে জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ‘ওরা নির্বাচনে না এলে আমাদের কিছু করার নেই’, এ কথা বলে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। কেন নির্বাচনে আসছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা আগেই জানিয়েছেন, বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। তবে নির্বাচনটি শুধু অংশগ্রহণমূলক হওয়াই যথেষ্ট নয়, সেটি হতে হবে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য।
দেশবাসী এমন একটি নির্বাচন চায়, যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন। তারা এমন নির্বাচন চায় যে নির্বাচনে আগের রাতে কেউ গিয়ে বলে আসবে না, ‘দাদা আপনি তো আমাদেরই ভোট দেবেন। কষ্ট করে আপনাকে কেন্দ্রে যেতে হবে না।’ সরকারের মনে যা-ই থাকুক না কেন, মন্ত্রী-নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হয় তাঁরাও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সঙ্গে আলোচনায় তাঁকে অনুরোধ করেছেন যেন বিএনপিকে নির্বাচনে আসার বিষয়ে তিনি সহায়তা করেন। একই ধরনের অনুরোধ করা হয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারকেও। (ইত্তেফাক, ২ মার্চ ২০১৮)। তোফায়েল আহমেদ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সরকার সে সময়ে রুটিন কাজ করবে। নির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মাধ্যমে সম্ভবত তিনি এই নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছেন যে নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তারা নির্বাচনের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। বার্নিকাট মন্ত্রীর কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। তিনি শুধু যোগ করেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের শর্তগুলো শুধু নির্বাচনের দিন নয়, সব সময়ের জন্যই মেনে চলা প্রয়োজন। অর্থাৎ সব দলকে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের বিধান। নির্বাচন কমিশনের কাছে বিএনপি চিঠি দিয়ে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী যখন জনসভা করে নৌকায় ভোট চাইছেন, তখন বিএনপির নেতাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, কর্মীদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না। হয় নৌকার পক্ষে ভোটের প্রচার বন্ধ করতে হবে, নয় তো তাঁদেরও ধানের শীষের পক্ষে প্রচার চালাতে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন এই চিঠির কী জবাব দেয় সেটাই দেখার বিষয়।
কমিশনের সচিব কূটনৈতিক ভাষায় বলেছেন, ‘তাঁরা আইনগতভাবে এটি নিষ্পত্তি করবেন।’ আইনের ভাষার পাশাপাশি ইসি যেন মানুষের মনের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। কমিশনের পদাধিকারীদের উদ্দেশ্য যদি হয় একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন তাহলে এখন থেকেই সবার জন্য মাঠ সমতল করার কাজটি করতে হবে। বিএনপির যেসব নেতা দণ্ডিত হয়েছেন বা জেলে আছেন, তাঁদের বিষয়টি এখানে আনছি না। কিন্তু যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা কেন শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারবেন না? ঢাকা শহরে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তারা কোনো দলকে চাওয়া মাত্র অনুমতি দেবে আর কোনো দল দিনের পর দিন ধরনা দিয়ে অনুমতি পাবে না, এটি হতে পারে না। বিষয়টি ইসিকে দেখতে হবে। তফসিলের দোহাই দিয়ে তারা নীরব থাকলে জনগণ ভাববে ইসি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ এবং কারও নির্দেশে কাজ করে। তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, শুধু তফসিলকালের জন্য নয়। নির্বাচনের এখনো আট-নয় মাস বাকি। তাই বর্তমান কমিশনের কাজকর্ম ও গতিবিধি সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। আমরা দেখতে চাইব জাতীয় নির্বাচনের ওপর যে দীর্ঘ কালো ছায়াটি পড়েছে, সেটি সরিয়ে ফেলতে কে এম নুরুল হুদা কমিশন সক্ষম কি না। হুদা সাহেবের সামনে দুটো পথ খোলা আছে-একটি হলো এ টি এম শামসুল হুদার, আরেকটি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ রচিত। এখন তিনিই ঠিক করুন কোন পথে হাঁটবেন।
সোহরাব হাসান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com

No comments

Powered by Blogger.