লজ্জা ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলাদেশ

জনপ্রিয় লেখক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হামলার শিকার হয়েছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠানে পুলিশি বেষ্টনীর ভেতরেই ছুরি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে এক যুবক। এতে তার শরীর রক্তে ভিজে যায়। দ্রুত তাকে সিলেটে ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা হামলাকারীকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। তার অবস্থাও গুরুতর। পরে হামলাকারীকে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ইলিয়াস উদ্দিন জানান, হামলার পর পরই মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তার অস্ত্রোপচারও করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর জাহিদ হাসান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চলাকালে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, অনুষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। একপর্যায়ে কয়েকজন হুলস্থূল শুরু করে। এর মধ্যে একজন জাফর ইকবালের মাথায় আঘাত করে। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে জড়ো হন। তাদের মধ্যে এক শিক্ষার্থী জানান, হামলার পরপরই তিনি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছেন। স্যার জানিয়েছেন, তিনি ওকে আছেন। নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন। প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী কয়েকজন জানান, স্যার মুক্তমঞ্চে বসেছিলেন। সামনে একটি রোবট প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। হঠাৎ হুলস্থূল শুরু হয় এবং এক যুবক এসে স্যারের মাথার পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্যারের শরীর রক্তে ভিজে যায়।
তারা জানান, মুক্তমঞ্চে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যেই স্যারের ওপর এ হামলা হয়।
ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সিলেট মেট্রোপলিটনের এডিসি আবদুল ওহাব বলেন, হামলায় জড়িত এক যুবককে আটক করা হয়েছে। জানা গেছে,   হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল (২৪) বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তবে তার মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, জাফর ইকবালকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার এবং বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি গত শুক্রবার বলেছিলেন, র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়ানো উচিত। ওই ছাত্রদের শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত। তবে ঠিক এ ঘটনায়, না রাজনৈতিক কারণে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা পরিষ্কার নয়।
হত্যার হুমকি:
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স স্কুলের ডিন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইয়াসমিন হককে ২০১৬ সালে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এজন্য ওই বছরের ১৪ অক্টোবর মহানগরীর জালালাবাদ থানায় সাধারণ ডায়রি (নং-৫৯২) করা হয়। সাধারণ ডায়রিতে উল্লেখ করা হয়, জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর থেকে নিরাপত্তায় তাদের বাসভবনে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র পুলিশ পাহারা বসানো হয়।
বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিবাদ:
২০১৫ সালে শাবিপ্রবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। শিক্ষকদের ওপর হামলার পরপরই ক্যাম্পাসে নেমে আসা বৃষ্টিতে তিনি বসে থেকে ভিজলেন, যেন অপমানের কান্না লুকাতে চান বৃষ্টির আড়ালে। তখন উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে সস্ত্রীক সক্রিয় ছিলেন।
দুই সন্তানের জনক: 
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন দম্পতির ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তান রয়েছে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলের নাম নাবিল ইকবাল এবং মেয়ের নাম ইয়াশিম ইকবাল।
পদত্যাগ:
শাহজালাল ও যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার পর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হক। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তখন লেখা এক খোলা চিঠিতে পদত্যাগের বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা সবসময়ই আমাদের সবকিছুর বিরোধিতা করে, আমরা তাদের বিরোধিতার বিরুদ্ধে এতদিন কাজ করে এসেছি। কিন্তু যারা আমাদের স্বজন, যাদের পাশে নিয়ে কাজ করে এসেছি, তারা যদি আমাদের পাশে না থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত পরীক্ষার পক্ষে যুক্তি দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, এতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বকীয়তা পুরোপুরি বজায় রেখে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারত। পার্থক্য বলতে, শুধু পরীক্ষা হতো এক প্রশ্নে। এতে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের ভোগান্তিও কমত। মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যখন এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন তখন আমাদের মনে হয়েছে, আমাদের সবকিছু নতুন করে ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
উত্তাল শাবি, ঢাকাতেও বিক্ষোভ:
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। ঘটনার পরপরই ক্যাম্পাসে উত্তেজনা দেখা দেয়। শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন। এছাড়া সড়ক অবরোধ করে রাখে। অধ্যাপক জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতের খবরে রাজধানীতেও বিক্ষোভ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে অবস্থান নেন। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চও বিক্ষোভ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা:
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহ্সানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে হামলাকারীকে আটক করে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসাধীন মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন।
হামলায় ‘চক্রান্ত’ দেখছে বিএনপি
শাবিপ্রবিতে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা একটি চক্রান্ত হিসেবে দেখছে বিএনপি। এ হামলায় ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
এ হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, তার (জাফর ইকবাল) ওপর হামলার ঘটনার আমরা তীব্র ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা কখনই এই ধরনের সন্ত্রাসের পক্ষে নই। আমরা মনে করি যে, এটা আরেকটা চক্রান্ত। যারা দেশে এই ধরনের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় এটা তাদেরই চক্রান্ত।
বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন খোলা কাগজকে বলেন, আমরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানাই। দেশের আইনের শাসন ও বিচার  না থাকায় মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে। বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই আমরা জাফর ইকবালসহ প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ বিচারের দাবি জানাই। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির খোলা কাগজকে বলেন, উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং দেশের স্বনামধন্য একজন লেখক। তার ওপর যেই হামলা করুক এটা কাপুরুষোচিত- এর জন্য আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।
পরিবর্তন ডটকম

No comments

Powered by Blogger.