উপহার পাঠানোর নামে কোটি টাকার প্রতারণা: রিমান্ডে নাইজেরিয়ান ফুটবলার

হেনরি ইশিকা (৪০)। নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেন। খেলাধুলার পাশাপাশি করেন অপরাধমূলক কর্মকা-। কয়েক বছর আগে গ্রেপ্তার হয়ে জেল হাজতে যান। সেখানেই সখ্যতা গড়ে তোলেন বাংলাদেশি নাগরিক মো. ইসমাইল হোসেন (৪৮) সঙ্গে।
কিছুদিন পর দু’জনেই জামিনে বের হয়ে আসেন। পুনরায় জড়িয়ে পড়েন অপরাধমূলক কর্মকা-ে। তবে এবার অপরাধের ধরন পরিবর্তন করেছেন। সহজ-সরল নারীদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে ফাঁদে পেলেন। তারপর বিভিন্ন কৌশলে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) হাতে আটক হেনরি ইশিকা ও মো. ইসমাইল হোসেন আটকের পর বের হয়ে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, নাইজেরিয়ান ফুটবলার হেনরি ইশিকা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ভাইবার, মেসেনজারের আইডি সংগ্রহ করে সহজ-সরল নারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। এরপর উপহার বা অনেক সময় চাকরি দেয়ার নাম করে আদায় করেন অর্থ। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেয়ার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ঠিক এমনই এক ভুক্তভোগী কাফরুলের তাহমিনা পারভীন। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। পিবিআই জানিয়েছে, তাহমিনার ফেসবুক আইডিতে কিছুদিন আগে উইলিয়াম ডেভিড নামের একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। সেই রিকোয়েস্টটি গ্রহণ করেন তাহমিনা। তখন মেসেনজারের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। একসময় উইলিয়াম ডেভিড তাহমিনার কাছে তার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার চায়। পরে দু’জনের হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথাবার্তা চলত। কিছুদিন যাওয়ার পর উইলিয়াম উপহার পাঠানোর জন্য তাহমিনার কাছে তার বাসায় ঠিকানা চায়। পরে তিনি তার বাসার ঠিকানা দেন। কয়েকদিন পর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে বেন কার্লোস নামের এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে বলেন তিনি ডেল্টা কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করেন। উইলিয়াম ডেভিড নামের এক ব্যক্তি ইংল্যান্ড থেকে একটি পার্শ্বেল পাঠিয়েছে। সেই পার্শ্বেলটি পাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের কাস্টমস অথরিটি ৪৫ হাজার টাকা দাবি করছেন। টাকা পরিশোধ করলেই সেই পার্শ্বেলটি পাওয়া যাবে। এজন্য বেন কার্লোস মো. সালাহ উদ্দিনের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কাওরান বাজার ব্রাঞ্চের একটি ব্যাংক হিসাব দেন। পরে তাহমিনা একই ব্যাংকের ডাচ্-বাংলা শাখা থেকে ওই হিসাবে ৪৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পেয়ে কার্লোস তখন উপহারটি দিচ্ছি দেবো বলে সময় নেন। এর কিছুক্ষণ পরে কার্লোস আবার তাহমিনাকে ফোন করে বলেন, ওই উপহারের প্যাাকেটের ভেতরে পাউন্ড আছে যা কাস্টমসের এক সিনিয়র কর্মকর্তার নজরে এসেছে। এজন্য আরো ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। এত টাকা পাঠানোর জন্য সময় চাইলে কার্লোস তখন মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে বলে ভয়ভীতি দেখান। মামলার ভয়ে তাহমিনা আবার মো. একরাম মুন্সী নামের আরেক ব্যক্তির ডাচ্-বাংলা ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। তখন কার্লোস তাকে তাহমিনাকে জানায় সময় মত উপহারটি পেয়ে যাবেন। পরের দিন আবার কার্লোস তাকে ফোন করে জানায় উপহারের প্যাকেটের ভেতরে বাংলাদেশি টাকায় ১ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮০ টাকা থাকায় শতকরা ৩ শতাংশ হারে ৩ লাখ ২৩ হাাজার ৩২০ টাকা ট্র্যাক্স জমা দিতে হবে। ওই সময় তাহমিনা কার্লোসের সঙ্গে দেঅক করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। তখন তাহমিনার আর বুঝার বাকি থাকে না তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন।
পিবিআই আরো জানায়, একই চক্রের প্রতারণার শিকার হন তুরাগ থানা এলাকার নাজিয়া তাবাসসুম ওরফে শাওন। তিনি মাস্টার মাইন্ড নামক একটি স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করেন। কিছুদিন পর অজ্ঞাত একটি মোবাইল নম্বর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে এক ব্যক্তি জানায় মাস্টার মাইন্ড স্কুলে চাকরি পেতে হলে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায়ে তাকে একটি ব্যাংক হিসাব নম্বর দেয়া হয়। পরে তিনি জনতা ব্যাংকের উত্তরা মডেল টাউনের একটি শাখা থেকে ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পাঠানোর পর শাওন ওই ব্যক্তির মোবাইল নম্বর বন্ধ পান। অভিযোগ পেয়ে পিবিআই তাদের মোবাইল নম্বর, ফেসবুক আইডি, হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটিং পর্যালোচনা করে ২রা মার্চ তাদেরকে পূর্ব তেতজুরী বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। আটক দু’জনই পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা এই কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। এই দুই ভোক্তভোগী ছাড়াও আরো অনেকের সঙ্গে এ রকম উপহার ও চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলাটি পিবিআই’র উপ-পরিদর্শক মো. জুয়েল মিঞা তদন্ত করবেন। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত দেশি বিদেশি আর কেউ জড়িত আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.