ইতালিতে যেমন আছেন বাংলাদেশীরা

উন্নত জীবনের প্রত্যাশ্যায় ইতালিতে অবস্থান করছেন এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশী। এর মধ্যে শুধু রোমেই আছেন ৩৬ হাজার বাংলাদেশী। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে সেখানে অভিবাসন আইন কিছুটা শিথিল হওয়ায় এর বেশির ভাগই পাড়ি জমিয়েছিলেন ইতালিতে। তখন তাদেরকে স্বাগত জানানো হলেও দৃশ্যপট পাল্টে গেছে এখন। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে ইউরোপমুখী অভিবাসীর ঢল নামার পর অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে ইতালি। এর ফলে সেখানে আর্থিক অস্থিরতা, ব্যাপক হারে বেকারত্ব দেখা দিচ্ছে।
ফলে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই তারা দলবেঁধে প্রহার করছে বাংলাদেশীদের। অশালীন ভাষায় গালি দিচ্ছে। তারপরও এসব বাংলাদেশী দেশে ফিরতে রাজি নন। কারণ, দেশে ফিরলে তাদের উপার্জনের পথ নেই। গত ২৯ শে অক্টোবর এমনই প্রহারের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশী কার্তিক চন্দ্র। তিনি রোমে একটি রেস্তোরাঁয় থালাবাসন ধোঁয়ার কাজ করেন। কার্তিক শুধু একাই নন, ২০১১ সালের পর ইতালির রাজনৈতিক দল ফরজা নুওভা’র আক্রমণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৫৯ জন বাংলাদেশী। এ খবর দিয়েছে অনলাইন টিআরটি ওয়ার্ল্ড। এতে বলা হয়, অক্টোবরে হামলার আগে কার্তিক তার সহকর্মীদের সঙ্গে মাথা নিচু করে কাজ করছিলেন। অকস্মাৎ তার দিকে তেড়ে যায় একদল মানুষ। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে- নোংরা কালো আদমি, এখানে তুমি কি করছো? কিন্তু কার্তিক অতো ভাল ইতালিয়ান ভাসা জানতেন না। তাই তিনি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন নি যে, তাকে অবমাননাকর গালি দেয়া হয়েছে। এখানেই সব শেষ হয়ে যায় নি। তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হলো। তার ওপর বৃষ্টির মতো পড়তে লাগলো লাথি, ঘুষি। এতে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন কার্তিক। বেহুঁশ হয়ে মৃতের মতো মাটিতে পড়ে থাকেন ২৭ বছর বয়সী কার্তিক। রক্তে সয়লাব হয়ে যায় রেস্তোরাঁর মেঝে। তখন এপাড়ে বাংলাদেশে তার ফোনের আশায় বসে আছেন তার মা। ছেলের ফোন না পেয়ে কার্তিকের মা ঊষা রানি নিজেই ছেলের ফোনে ফোন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্যপাড়ে তখন ফোনের সুইট বন্ধ করা। বাধ্য হয়ে তিনি ফোন করেন কার্তিকের বন্ধুদের। তারাই তাকে জানান যে, কার্তিককে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কারণ, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ঊষা রানি বলেন, এ কথা আমি বিশ্বাস করি নি। তিনি ছেলের মুখের কথা শোনার জন্য কাকুতি জানান। কিন্তু অন্যপাড়ে কার্তিক ব্যান্ডেজে মোড়া। তার কথা বলার মতো সামর্থ নেই। তবে তিনি তার বন্ধুদের অনুরোধ করেছিলেন প্রকৃত সত্যা তার মাকে না বলতে। এক সপ্তাহ পরে কার্তিক তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন দেশে আমার পরিবারের আটজন মানুষ। এ জন্যই আমি বন্ধুদেরকে প্রকৃত সত্য বলতে বারণ করি। ওদিকে তার পরিবারকে বন্ধুরা বিশ্বাস করায়, কার্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছাড়ছে। তারা দেশ ছাড়ছে। একটু শান্তিতে বসবাসের আশায় সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছার চেষ্টা করতে থাকে ইউরোপে। এক্ষেত্রে ইতালি হয়ে ওঠে তাদের প্রধান আকর্ষণ। ইতালির সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালেই এক লাখ ৮১ হাজার অভিবাসী পৌঁছেছেন ইতালিতে। এরপর লিবিয়ার সঙ্গে ইতালির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ২০১৭ সালে এসব অভিবাসীর সংখ্যা নেমে আসে এক লাখ ১৯ হাজারে। গত মাসে মাসেরাতা শহরে উগ্র ডানপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এমন একজন ইতালিয়ান লুসা ট্রেইনি’কে গুলি করে ৬ আফ্রিকান অভিবাসী। এমনতরো অনেক অপরাধের ফলে ইতালিতে বেড়ে ওঠে অভিবাসী বিরোধী প্রচারণা। রোববারের নির্বাচনে তাই অভিবাসী ইস্যুটি বড় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৯ ভাগ ইতালিয়ান অভিবাসীদের কারণে হুমকিতে আছেন বলে মনে করেন। ওদিকে মাসেরাটা শহরের হামলাকে প্রকাশ্যে শুধু সেলিব্রেট করেছে ফরজা নুভা (নিউ ফোর্স)। এই রাজনৈতিক দলটি বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনের নস্টালজিয়াকে ধারণ করে। এ দলটির একজন কর্মী গত নভেম্বরে ইতালির পত্রিকা লা রিপাবলিকা’কে বলেছিলেন, আপনি যখন একজন বাঙালিকে চূড়ান্তভাবে শাস্তি দেবেন তখনই আপনার বাংলা ট্যুর সম্পন্ন হবে। ওই রাজনৈতিক কর্মী আরো বলেছিলেন, কেন আমরা বাংলাদেশী লোকজনকে পছন্দ করি? কারণ, তারা ভদ্র, শান্ত। কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া আমাদের ঘুষি হজম করে। কার্তিকের ওপর হামলা তদন্তে দেখা যায়, তার ওপর হামলাকারীরা ফরজা নুভা’র সমর্থক। বিচার বিভাগীয় তদন্তে দেখা যায়, ফরজা নুভার নেতাদের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কার্তিক চন্দ্রের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। তোমরা কেন এভাবে হামলা করো? একজন মনোবিজ্ঞানীর এমন প্রশ্নের উত্তরে ফরজা নুভা’র একজন কর্মী স্বীকার করেছিলেন- ‘আমরা মজা করতে এমন হামলা করি। বিদেশীদেরকে ইতালিতে থাকা অথবা ইতালিতে আসা অনুৎসাহিত করার জন্য এমন হামলা চালাই আমরা। কিন্তু এমন অভিবাসী বিরোধী মনোভাবও কার্তিকের মতো বাংলাদেশীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে নি। তাদেরকে ইতালিছাড়া করতে পারে নি। ইতালিতে কার্তিকের কাজটি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। কার্তিক এমন অত্যাচার সয়েও বলেছেন, কখনো আমি বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবি না। কারণ, দেশে ফিরে আমার করে খাওয়ার মতো কোনো কাজ নেই। উল্লেখ্য, হামলায় আহত হওয়ার পর প্রায় ৫ মাস কেটে গেছে। কিন্তু এখনও তিনি ভালমতো দেখতে পান না। টিআরটি ওয়ার্ল্ড লিখেছে, কার্তিকের মতো এমন যুবকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে একপেশে হয়ে গেলেও তাদেরকে কাজ দেয়ার মতো কিছু নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সরকার নতুন নতুন বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশকে বর্ণনা করা হচ্ছে নতুন এশিয়ান টাইগার। কিন্তু এর রাজধানী ঢাকায় গরিব মানুষে ভরা। অনেক মানুষকে দেখা যাবে রাস্থায় ভিক্ষা করছে। ঢাকা শহর সম্পর্কে ওই রিপোর্টে বলা হয়, এখানে একটির সঙ্গে গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে দালান। বাতাসে মোটা একটি স্তর সৃষ্টি হয়েছে ধোয়ার। এতে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। রাস্তায় কর্ণ বিদারণকারী গাড়ির হর্ন। ফুটপাত ব্যস্তায় ভরা। স্থান সংকুলান হচ্ছে না সেখানে। এখেেন ঘন্টায় ২০ সেন্ট হিসেবে যারা কাজ করতে চান তাদের জন্য কাজ আছে। অন্যদিকে গ্রাম এলাকার পরিবেশ আরো খারাপ। ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে ছয়সুতি নামে একটি ছোট্ট গ্রামে বসবাস করেন কার্তিকের পরিবার। সেখানে পুকুরের পানি দূষিত। যে কূপ থেকে পানি তোলে গ্রামবাসী তাতে ২০ বছর ধরে আর্সেনিক সংক্রমণ। ঢাকা থেকে ছয়সুতিয়া যেতে সময় নেয় আট ঘন্টা। সেখানেই কার্তিকের ভাই পলাশ বলেন, পরিকল্পনা নিয়েছিলাম ভাইকে সাহায্য করতে রোমে যাবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য। অভিবাসন বিষয়ক নীতিতে পরিবর্তনের কারণে আমার আর সে সুযোগ হয় নি। কর্মহীন হয়ে সারাদিন বাড়িতেই বসে কাটাতে হয় আমাকে। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাংবাদিক কার্তিকদের গ্রামে গিয়েছিলেন। কার্তিকের মার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের। ঊষা রানি যখন তার ছেলের কথা বলছিলেন তখন তার চিবুক বেয়ে কান্না ঝরছিল। তিনি জানান, এক পর্যায়ে আমাদেরকে কার্তিকের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়। এ ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না। শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতেই কার্তিক তার পিতার দোকানের জন্য কাঠ কাটা শুরু করেন। একদিন তাদের দোকানে যখন কাজ করছিলেন তখন কার্তিক শুনতে পান বিকট একটি শব্দ। তাকিয়ে দেভেন পিছনে পড়ে আছেন তার পিতা। তারপর থেকেই কার্তিকের পরিকল্পনায় চলে আসে ইতালি।

No comments

Powered by Blogger.