জাফর ইকবাল ছুরিকাহত: হামলাকারী যুবক আটক, বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ

সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে পুলিশ, শিক্ষার্থীর সামনেই তার ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় গুরুতর আহত ড. জাফর ইকবালকে তাৎক্ষণিক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে মাথায় প্রাথমিকভাবে অস্ত্রোপচার করা হয়। রাতেই তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এদিকে ঘটনার পরপরই হামলাকারীকে আটক করে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা।
তবে তার পুরো পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে ওসমানী হাসপাতালে ড. জাফর ইকবালকে দেখতে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। হামলার প্রতিবাদে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। হামলার পর পরই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এ ঘটনাকে আরো একটি চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছেন।
বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে সোচ্চার ড. জাফর ইকবাল উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর হুমকি পেয়ে আসছিলেন। হুমকির প্রেক্ষিতে তার নিরাপত্তায় পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করতেন। ঘটনার সময়ও তার নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ ছিল।
ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লাঠিসোটা হাতে নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই দিনব্যাপী উৎসব চলছিল। শুক্রবার সকালে ড. জাফর ইকবাল ওই উৎসবের উদ্বোধন করেন। গতকাল ছিল উৎসবের শেষদিন। ড. জাফর ইকবাল সমাপনী অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি ছিলেন। বিকাল পাঁচটার কিছু আগে মুক্তমঞ্চে বক্তব্য দেয়ার জন্য যাওয়ার সময় ছুরি হাতে এক যুবক তার ওপর হামলা চালায়। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, হঠাৎ এসে ওই যুবক ড. জাফর ইকবালের উপর এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এ সময় ড. জাফর ইকবাল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থলে হুলস্থূল শুরু হয়। পুলিশ ও উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এসে জাপটে ধরেন হামলাকারীকে। রক্তাক্ত অবস্থায় ড. জাফর ইকবালকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে প্রথমে ড. জাফর ইকবালকে হাসপাতালের ৩য় তলার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে রাখা হয়। তখনও ড. জাফর ইকবালের মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। ডাক্তাররা রক্ত বন্ধ করতে তার প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দেন। কিন্তু তাতেও রক্ত বন্ধ হয়নি। এর পরপরই ড. জাফর ইকবালের মাথায় সিটিস্ক্যান করা হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার শরীরে দুই ব্যাগ ও পজেটিভ রক্ত দেয়া হয়। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একজন চিকিৎসক অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে জানান, ‘স্যার এখন আশঙ্কামুক্ত। তার শরীরে রক্ত দেয়া হয়েছে। এদিকে ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে আহত জাফর ইকবালকে ঢাকায় আনার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনায় রাতেই তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করা হয়। ওসমানী হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ড. জাফর ইকবালের মাথায় তিনটি, পিটে ও হাতে একটি করে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে।
হামলার পরপরই আটক হামলাকারীর পরিচয় এবং কি কারণে হামলা করেছে এ বিষয়ে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় অনুষ্ঠান চলাকালে হামলাকারী ওই যুবক ড. জাফর ইকবালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। হামলার পর ওই যুবককে শিক্ষার্থীরা আটক করে পিটুনি দেয়। পরে অজ্ঞান অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের একটি কক্ষে তাকে রাখা হয়। পুলিশ জানিয়েছে অজ্ঞান অবস্থায় থাকায় তার কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাইরে অবস্থান করায় প্রথমে হামলাকারীকে হাসপাতালেও নিতে পারেনি পুলিশ। রাতে তাকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হামলার ঘটনা তদন্তে এবং আটক যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি দল সিলেট যাচ্ছে। এদিকে ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার খবর শোনে হাসপাতালে ভিড় করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও তার ভক্তরা। সেখানে ছুটে যান সিলেটের রাজনীতিক ও পেশাজীবীরা। তারা ঘটনার নিন্দা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশিষ্ট লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে হামলাকারীকে আটক করে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসাধীন মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাফর ইকবালের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এ ছাড়াও নাসিম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে সার্বক্ষণিক জাফর ইকবালের চিকিৎসার খোঁজখবর রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম পৃথক এক বিবৃতিতে সিলেটে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল: অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতের প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় শাহবাগে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। হামলার পর পরই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন। এর আগে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার তার ফেসবুক পেজে দেয়া স্ট্যাটাসের মাধ্যমে মঞ্চের কর্মীদের জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ড. জাফর ইকবাল স্যারের ওপর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেন মঞ্চের কর্মীরা। মিছিলটি শাহবাগ থেকে টিএসসি হয়ে আবার শাহবাগে ফিরে আসে। সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের একটি দলও প্রতিবাদ জানাতে উপস্থিত হন সেখানে। জাফর ইকবালের ওপর হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, তার ওপর এভাবে হামলা হবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। শুধু জাফর ইকবালই নন, আমরা কেউই নিরাপদ না। মুক্ত চিন্তা ও বাংলাদেশের প্রগতিশীলতার চর্চাকে নস্যাৎ করতেই এ হামলা করা হয়েছে। জাফর ইকবালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা হয়েছে। হামলার দায় সরকার এড়াতে পারে না মন্তব্য করে ইমরান সরকার বলেন, “জাফর ইকবালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার নিয়েছিল। সুতরাং সরকারের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করেই এ হামলা হয়েছে। এ কারণে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, কোনো রাজনীতিবিদের ওপর তো হামলা হয় না। হয় শুধু লেখক আর মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের ওপর। সরকার মনে করে, যারা এ রকম হামলা করে তাদের চেয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যারা লেখালেখি করে তাদের ঠেকানো জরুরি। এ হামলার দায় সম্পূর্ণ সরকারের। হামলার প্রতিবাদে রোববার বিকাল ৪টায় শাহবাগে কর্মসূচির ডাক দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, যে পর্যন্ত সরকার হামলার ব্যাপারে আন্তরিক অবস্থান না নেবে এবং হামলাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেবে ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে। এদিকে চট্টগ্রামেও বিক্ষোভ করেছেন মঞ্চের কর্মীরা।

No comments

Powered by Blogger.