যৌন সহিংসতা: দায়ী কিছু ধারণা by লায়লা খন্দকার

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৮৯৪ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৯৩ জন ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর শিশু হত্যা বা শিশুর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মেয়েশিশুরা গণধর্ষণ, বখাটেদের হামলায় জখম, পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে। সন্দেহ নেই যে এই সময়ে বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতন ভয়াবহ একটি সমস্যা। এর মূল কারণ কী?
শিশু নির্যাতন বুঝতে হলে সমাজে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন সহ্য করার সংস্কৃতি রয়েছে। নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। নারী ও পুরুষ সম্পর্কে প্রচলিত সামাজিক কিছু ধারণা যৌন সহিংসতার অন্যতম কারণ। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, পুরুষেরা তুলনামূলক বেশি ক্ষমতাশালী, তাই যৌন সম্পর্ককেও তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। যেন জোর খাটানো তাদের অধিকার। ক্ষমতার অসমতা নারীকে পুরুষের অধস্তন করে রেখেছে এবং পুরুষদের আধিপত্য বজায় রাখতে সহায়তা করছে। যেসব পুরুষ এমন আধিপত্যবাদী মনোভাব ধারণ করে, তাদের ধর্ষক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যৌন নির্যাতন ঘটে একধরনের মানসিক অবস্থা থেকে, যা পুরুষের মনে এই ধারণা দেয় যে তাদের যৌন অধিকার আছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা নারীদের অবমূল্যায়ন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছেলেশিশু শৈশবে মাকে নির্যাতিত হতে দেখেছে, পরবর্তী সময়ে তাদের সঙ্গীকে নির্যাতন করার আশঙ্কা আড়াই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়। শিশু নির্যাতনের সঙ্গেও বিষয়টি সম্পর্কিত। যেসব ছেলেশিশু শৈশবে নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয়েছে, তাদেরও পরবর্তী সময়ে নির্যাতনকারী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। মেয়েদের অর্জনকে শ্রদ্ধা না করে বরং তাদের উত্ত্যক্ত করার মানসিকতা থেকেও আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়। ঢাকা ও অন্য বড় শহরগুলোতে শিশুদের খেলার মাঠ কমে আসছে। যেগুলো এখনো আছে, সেগুলো মূলত ছেলেরাই ব্যবহার করে। আমাদের মেয়েরা ঘরের বাইরে কিংবা খোলা জায়গায় খেলাধুলার সুযোগ খুব কমই পায়। তারপরও মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলের সাফল্য আমাদের গর্বিত করে। কিন্তু সেই মেয়েরাই ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে বাসে পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিল। এ জন্য কি আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত নয়? যত দিন আমরা নারীদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখব এবং তাদের মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা না করব, তত দিন তারা যৌন সহিংসতার শিকার হবেই।
যৌন নির্যাতনের জন্য নারীদের পোশাক বা আচরণকে দায়ী করার মানসিকতাও অনেকের মধ্যে আছে। কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে কেন সে বাইরে গিয়েছিল কিংবা কেমন পোশাক পরেছিল, সেই বিচার করা শুরু হয়ে যায়। গণমাধ্যমে অনেক সময় নারী ও পুরুষের ভূমিকাকে এমনভাবে দেখানো হয়, যা আদতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই প্রতিফলন। মেয়েরা যেন শুধু শারীরিক সৌন্দর্য নিয়েই সচেতন। স্ত্রী কিংবা মা হিসেবে তাদের ভূমিকার ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জোর দেওয়া হয় এবং তাদের পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হিসেবে তুলে ধরা হয়। অধিকাংশ নাটক বা বিজ্ঞাপন দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নারীর দায়িত্ব শুধু সন্তান পালন এবং ঘরের কাজ করা। কিন্তু বাস্তবতা একদমই ভিন্ন। অনেক নারী এখন বিভিন্ন পেশায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। তাঁরা অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। অনেক মা-বাবাই ছেলেসন্তানকে মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। সব সংস্কৃতিতেই শৈশব থেকে ছেলে ও মেয়েদের আলাদাভাবে দেখা হয়, তবে এটা তীব্র হয় কৈশোরে। এই সময়ে ছেলেদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যায় আর মেয়েদের সুযোগ সংকুচিত হতে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের নিজেদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ, চলাফেরার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বাড়ে। অন্যদিকে মেয়েরা তাদের জন্য সমাজ-নির্ধারিত ভূমিকায় অভ্যস্ত হতে থাকে। ফলে নিজেদের জীবনের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক পুরুষ তখন নানা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ (যেমন ধূমপান বা মদ্যপান, জোরে গাড়ি চালানো, একাধিক যৌন সম্পর্ক স্থাপন) করতে শুরু করে। এর মূলে রয়েছে পুরুষত্ব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, যেখানে তাদের ‘শক্তিশালী’ হিসেবে মনে করা হয়। নারীরা নিজেদের মতামতকে অনেক সময় তুলে ধরতে পারে না, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। এর মূলেও আছে নারীত্ব নিয়ে কিছু অমূলক ধারণা, যেখানে তাদের অসহায় বা অতিরিক্ত কোমল বলে মনে করা হয়। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষের ভূমিকার যে ধারণা নিয়ে ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে, তা তাদের মানবিক সম্ভাবনার বিকাশ ব্যাহত করছে। নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
পুরুষদের যত্নকারী/পরিচর্যাকারী হিসেবে সম্পৃক্ত করতে পারলে নির্যাতনের মাত্রা কমে। এ রকম উদাহরণ পৃথিবীর অনেক দেশে আছে। এর মধ্যে আছে পিতৃত্বকালীন ছুটি, মা-বাবার জন্য সন্তান পালনবিষয়ক প্রশিক্ষণ, সন্তান জন্মের সময় বাবার উপস্থিত থাকা এবং নবজাতকের পরিচর্যায় বাবার অংশগ্রহণ। এর ফলে বাবা ও সন্তানদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয় এবং পরিবারে নির্যাতন কমে। শৈশব থেকেই যদি ছেলেমেয়েদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ শেখানো যায়, তাহলে নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব। নির্যাতন করা যে শক্তিমত্তার প্রকাশ নয় তা ছেলেদের বোঝাতে হবে। নারীত্ব ও পুরুষত্ব-সংক্রান্ত যেসব ধারণা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর, তা থেকে তাদের মুক্ত করা প্রয়োজন। ছেলেদের জন্য স্কুলকেন্দ্রিক কর্মসূচি প্রচলন করতে হবে, যেখানে তারা মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা পাবে। নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন জরুরি। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব কার্যক্রম শুধু নারীর ক্ষমতায়ন ঘটায়, তা পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ এসবের ফলে পুরুষেরা একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। পুরুষদের যদি নারীদের সহযোগী হিসেবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে ইতিবাচক ফলাফল আসে এবং দম্পতিদের মধ্যে সংঘাত কমে। সনাতন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারী ও পুরুষ পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী হয়ে উঠুক। তারা যদি সমতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজ গড়ার সংগ্রামে সহযোদ্ধা হয়, তাহলেই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে।
লায়লা খন্দকার: সেভ দ্য চিলড্রেন-এর চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রটেকশন পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.