উত্তর-পূর্ব রাজ্যের ভোট by গৌতম লাহিড়ী

'চলো পাল্টাই' স্লোগানে ত্রিপুরায় ইতিহাস গড়লেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের রীতিমতো চমকপ্রদ ঘটনা ২৫ বছরের সিপিএম-লালদুর্গের পতন এবং গৈরিক বিজেপির ক্ষমতা দখল। একই সঙ্গে উত্তর-পূর্বের অন্য দুই রাজ্যেও বিজেপির প্রভাব বিস্তার। এই তিনটি রাজ্যই প্রতিবেশী বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া। এই ফলে ভারতের বাংলাদেশ নীতির কোনো প্রভাব পড়ে কি-না তাও দেখার বিষয়। তবে বিজেপি আসামে যেমন বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিল; এখানে তা করেনি। বরং বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে ত্রিপুরার আর্থিক উন্নয়নে সহযোগিতা করছেন- সেই প্রচার ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদির। ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে অতি সাধারণ দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন মানিক সরকার। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি গেরুয়া-ঝড়ে দলের ধরাশায়ী হওয়াকে রুখতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হয়েছে আগেই। এবার লালদুর্গ ত্রিপুরার পতন। একমাত্র কেরালায় সিপিএমের শাসন রয়েছে। তাও কেরালায় পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তন হয়ে থাকে। সার্বিকভাবে ভারতের রাজনীতিতে বাম রাজনীতির ক্ষয়িষুষ্ণ হয়ে যাওয়া এবং হিন্দুত্ববাদী বিজেপির রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই এখন রাজনীতির ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপি লক্ষ্য স্থির করেছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যেসব রাজ্য থেকে সর্বাধিক আসনে জয়ী হয়েছিল, সেখানে আগামী নির্বাচনে সাফল্য নাও পেতে পারে। তাই যেসব রাজ্যে বিজেপি কখনোই প্রভাব বিস্তার করেনি, সেসব রাজ্যকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন মোদি-অমিত শাহ জুটি। সিকিমকে যোগ করলে উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যের মোট ২৫টি লোকসভা আসন রয়েছে। বিজেপি পাখির চোখ করেছে এসব রাজ্যে। টার্গেটে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ত্রিপুরার 'ভদ্র বাঙালি' যদি বিজেপিকে সাদরে গ্রহণ করে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও তার প্রভাব পড়তে পারে। এটা জানেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাই তিনি ভোটের ফল প্রকাশের আগে বিধানসভায় সিপিএম নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'আপনারা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা করেন না। কিন্তু আমি চাই ত্রিপুরায় সিপিএম জিতুক। যদিও আপনারাই যাই যাই করছেন।' এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যের মধ্যে ছয়টিতেই বিজেপি সরাসরি অথবা স্থানীয় আঞ্চলিক দলের সহযোগিতায় সরকারে থাকছে। নাগাল্যান্ড- আঞ্চলিক ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টির সহযোগিতায় সরকার গড়ছে। মেঘালয়ে শেষ পর্যন্ত বিজেপি শরিকদের সঙ্গে সরকার গড়তে পারে। একদিকে এই নির্বাচন যেমন বামদের অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে, তেমনি একদা প্রভাবশালী কংগ্রেসকেও প্রভাবহীন করে দিয়েছে। গেরুয়া-ঝড়ে তেরঙ্গাও ম্লান। ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ডে কংগ্রেসের ঝোলায় আসন সংখ্যা শূন্য।
একদা ত্রিপুরায় কংগ্রেসই বামপন্থিদের হারিয়েছিল। তারাই ছিল প্রধান বিরোধী দল। গত নির্বাচনেও যখন নরেন্দ্র মোদি গোটা ভারতে জয়-পতাকা উড়িয়েছিলেন, ত্রিপুরায় বামপন্থিদের দুর্গ ছিল অটুট; বিজেপি ভোট পেয়েছিল মাত্র দেড় শতাংশ। সেই বিজেপি ৫০ শতাংশ ভোট কুড়িয়ে নিল মাত্র চার বছরের মধ্যে। আদিবাসী সংগঠন নিয়ে আসন পেতে চলেছে দুই-তৃতীয়াংশ। ত্রিপুরার মতো রাজ্যে বাম ব্যতীত তৃণমূল কংগ্রেসকেও অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা নিঃসন্দেহে বিজেপির উষ্ণীষে নয়া পালক বলতে হবে। ত্রিপুরায় বামপন্থিদের একটানা বাম শাসনের একটা একঘেয়েমি এসেছিল ঠিকই; একে সিপিএম ধরতে পারেনি। এ ছাড়া গত দু'বছর ধরে আরএসএস লাগাতার বুথ স্তরে সংগঠন তৈরির কাজ করেছে। দিল্লি থেকে আরএসএস নেতারা ঘাঁটি গেড়ে বসে ছিলেন আগরতলায়। এর সঙ্গে অমিত শাহর কুশলী সাংগঠনিক দক্ষতাকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিপুরার আদিবাসী এলাকার অসন্তোষ। ইনডিজেনাস আদিবাসী ফ্রন্ট প্রথমে পৃথক রাজ্য গড়ার ডাক দিয়ে আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। একে সিপিএম-কংগ্রেস বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দিলেও মোকাবেলা করতে পারেনি। বিজেপি যদিও বলেছিল, তারা পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন করে না; কিন্তু প্রকারান্তরে সেই আন্দোলনকেই প্রশ্রয় দিয়েছিল। আদিবাসী ছাড়াও ত্রিপুরার সাধারণ চাকরিজীবীদের মন জয় করতে বিজেপি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের মতো বেতন বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাম প্রভাব খর্ব করতে পেরেছে। কেননা, ত্রিপুরায় সিপিএম সরকার এখনও চতুর্থ বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন দিচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্যই বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। এখানে যেমন বাংাদেশের সঙ্গে সড়ক, বিদ্যুৎ ও রেল যোগাযোগ বাড়িয়েছে, তেমনি সীমান্ত হাট খুলে স্থায়ী বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই নরেন্দ্র মোদি পূর্বের সরকারের 'লুক ইস্ট' নীতির পরিবর্তন করে 'অ্যাক্ট ইস্ট' নীতির বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের নীতি অনুযায়ী আসামের বিজেপি সরকার নাগরিক পঞ্জিকরণের নামে যেমন বিদেশি বলে মুসলিমদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে; ত্রিপুরার মতো রাজ্যে সেই নীতি রূপায়ণ করলে ফের অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হতে পারে। তাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে। বিশেষ করে এই বছরের শেষে বাংলাদেশেও সাধারণ নির্বাচন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রত করতে পারে। তবে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, উত্তর প্রদেশসহ হিন্দি বলয়ে বিজেপি যেভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রচার করেছে, সে ধরনের কোনো প্রচার এই তিন রাজ্যে করেনি। ত্রিপুরায় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অন্যতম স্টার প্রচারক ছিলেন। তার কারণ তার রাজ্যের গোরক্ষপুরে যে হিন্দু মঠ রয়েছে, তাদের প্রভাব রয়েছে ত্রিপুরাতেও। নাথ সম্প্রদায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই নির্বাচনে। ফলে এখানে নরম হিন্দুত্ব প্রচার করেছে বিজেপি। তেমনি মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রভাব থাকলেও বিজেপির প্রভাব বিস্তার করতে অসুবিধা হয়নি। এমনকি এখানে গোমাংস প্রধান  খাদ্য হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি নিষিদ্ধ  করার কোনো ডাক দেয়নি, বরং বিজেপি নেতারা বলেছেন- এখানে গোমাংস নিষিদ্ধ করা হবে না। ফলে যেখানে যেমন তেমন ভোটের রণনীতি প্রয়োগ করছে বিজেপি। এটা ঠিকই, উত্ত-পূর্ব ভারতে প্রভাব বিস্তার করায় বিজেপি এখন কেবল গো-বলয়ের পার্টি বলা যাবে না; তারা আসন্ন কর্ণাটকের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত বিজেপির ব্যাপ্তি ব্যাপক। এসব রাজ্যে নিজেদের দলীয় নেতা না থাকলেও অন্য দল থেকে নেতাদের শামিল করে প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতের কূটনীতিবিদদের বক্তব্য- উত্তর-পূর্ব ভারতে যোগাযোগ বিস্তার করার জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী রাষ্ট্র। এখানে নরেন্দ্র মোদির দল এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে দুই দেশের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। এর দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে অন্য প্রতিবেশীদের সম্পর্ক উন্নত নয়। কোনো কারণে বাংলাদেশের স্থিতাবস্থা বিনষ্ট হলে ভারতেরই বিপদ- এটা প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য স্লোগান দেওয়া আর সরকার পরিচালনা করা পৃথক বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.