গ্রামের মেয়েরাই ওদের টার্গেট by রুদ্র মিজান

দৌলতুননেছা। বগুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ-সরল, সুন্দরী নারী। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। মা-বাবার টানাপড়েনের সংসারে ঠাঁই নেন তিনি। নিজেকে তখন বোঝা মনে হতো তার। হন্যে হয়ে একটা চাকরি খুঁজছিলেন দৌলতুননেছা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে যান তিনি। এই অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় প্রতারক চক্র। দেশের বাইরে মোটা বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখানো হয় তাকে। এভাবেই নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে নগদ টাকাসহ বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে পা বাড়ান দৌলতুননেছা। এ নারীসহ ৩৫ নারী তাদের কবল থেকে উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাব উদ্ধার করেছে নয় জনকে। কিন্তু চার শতাধিক নারীকে এই চক্র পাচার করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
র‌্যাব-২ এর কার্যালয়ে কথা হয় প্রতারণার শিকার দৌলতুননেছার সঙ্গে। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিভাবে নারী পাচারকারী চক্রের দালাল তাকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দিচ্ছিলো তার করুণ বর্ণনা দেন তিনি। তিনি জানান, তার প্রাক্তন স্বামী আরিফুল হাসান রুবেলের বন্ধু কামরুল ইসলামই তাকে বিদেশে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখায়। আরিফের সঙ্গে ডিভোর্সের তিন-চার বছর পর আড়াই মাস আগে হঠাৎ করেই ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কামরুল। এ সময় নিজের অসহায়ত্বের কথা তোলে ধরলে কামরুল তাকে চাকরি করবেন কি-না জানতে চায়। কামরুল জানায়, সরকারিভাবে সৌদি আরবে পাঠানোর একটা সুযোগ আছে। সেখানে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রতি মাসে তাকে ৩০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। রাজি থাকলে ৫০ হাজার টাকা ও প্রয়োজনীয় কাগজ-কাপড়সহ কালই ঢাকায় যেতে বলে। পাসপোর্ট-ভিসাসহ বাকি সব ব্যবস্থা করে দেবে কামরুল। পারিবারিক বিষয় শোনার পর কামরুল জানায়, বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি কাউকে জানানো যাবে না। জানলে কেউ তাকে যেতে দেবে না। দৌলতুননেছাও রাজি হন।
দৌলতুননেছা জানান, পরিবারে কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। ছোট ভাই-বোন লেখাপড়া করে। দৌলতুননেছার পিতা আহত মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান। একজন কৃষক। কৃষি জমির আয়ে টেনেটুনে সংসার চলে তাদের। এই অবস্থায় কামরুলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি। দৌলতুননেছা জানান, পরদিন নিজের জমানো ৫০ হাজার টাকা ও ব্যাগ গুছিয়ে সবার অজান্তে বাড়ি থেকে বের হন। টঙ্গী থেকে দৌলতুননেছাকে রিসিভ করে কামরুল। ওই দিন তার বাসায় রাত যাপন শেষে সকালে উত্তরার আল-আতিক বিডি লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে নাম, ঠিকানাসহ ফরম পূরণ, আলোকচিত্র ধারণ শেষে তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায় আল-আতিক কর্তৃপক্ষ। তারপর ভাষা শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকার কথিত প্রশিক্ষণ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটে তার মতো ৩৫ জন নারীকে দেখতে পান। একইভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সৌদি আরবে পাঠানোর জন্য তাদের জড়ো করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের নামে প্রায় দুই মাস তাদের সেখানে রাখা হয়। এর মধ্যেই পাসপোর্ট তৈরি ও মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়। দেশের বাইরে পাঠানোর কাজ প্রায় সম্পন্ন। এর মধ্যেই দৌলতুননেছা বাড়িতে যোগাযোগ করার কথা বলেন। দেশের  বাইরে যাওয়ার আগে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আপত্তি জানায় সেন্টারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা রীনা বেগম। দৌলতুননেছা জানান, ওই কেন্দ্র প্রবেশের পর থেকে কাউকেই বাইরে বের হতে দেয়া হতো না। ফোনে কথা বলা ছিল নিষিদ্ধ। কারও সঙ্গেই মোবাইলফোন রাখতে দিতো না। দুই মাসের মধ্যে দৌলতুননেছা একবার জ্বরে আক্রান্ত হন। তখনও বাইরে কোন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বাইরে যাওয়ার খুব বেশি আবদার করলে বিদেশে যাওয়া হবে না বলে হুমকি দিতো। এমনকি অনেক সময় মারধরও করা হতো অনেককে। এই অবস্থাতেই প্রতিবেশী এক নারীর সহযোগিতায় বাড়িতে ছোট বোন মিতুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন দৌলতুননেছা। মিতুকে তিনি জানান, কয়েক দিনের মধ্যেই দেশের বাইরে চলে যাবেন তিনি। মিতু জানতে চায়, আপা তুমি কোথায় আছো? এই উত্তর দেয়ার আগেই ফোন কেড়ে নেয় রীনা।
এদিকে হন্যে হয়ে মেয়েকে খুঁজছিলেন দৌলতুননেছার মা-বাবা। তার মা গুলশান আরা জানান, এই ঘটনার পর থেকে ওই ফোনটি বন্ধ পান। কয়েকদিন আগে ওই নম্বরে কল করে জানতে পারেন ওই এলাকার নাম কামারপাড়া। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় এসে কামারপাড়া এলাকার বিভিন্ন বাসায় মেয়ের খোঁজ করছিলেন তিনি। ভাড়া বাসার অজুহাতে খোঁজ করতে গিয়ে গত সোমবার বিকালে কামারপাড়ার ছয় নম্বর সড়কের চতুর্থ তলার একটি  বাসায় তার মেয়ের সন্ধান পান তিনি। ওই সময়ে ওই বাসায় অভিযান চালাচ্ছিল র‌্যাব-২। র‌্যাবের সহযোগিতায় দৌলতুননেছাসহ নয় নারীকে উদ্ধার করা হয়। অন্য নারীরা অভিযান চলাকালে বাসা থেকে নিজের মতো করে চলে যায় বলে দৌলতুননেছা জানিয়েছেন। দৌলতুননেছার বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার বড় নিলাহালী।
এ বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, দীর্ঘদিন থেকে উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরে অফিস নিয়ে নারী পাচার করছিল এই চক্র। সংবাদ পেয়ে অভিযান চালিয়ে নয় জনকে উদ্ধার করা হয়। সেই সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ১৯৫টি পাসপোর্ট, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নগদ ২লাখ ৫০ হাজার ১২৭ টাকা উদ্ধার করা হয়। মুফতি মাহমুদ খান জানান, বিভিন্ন সূত্রমতে এ পর্যন্ত এই চক্র বিভিন্ন দেশে চার শতাধিক নারীকে পাচার করেছে। এই চক্রটি সরলমনা মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। আল-আতিক বিডি লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানটির বৈধ কোন কাগজপত্র নেই। রিক্রুটিং এজেন্সির কোন লাইসেন্স নেই। মূলত প্রতারণা করে নারীদের বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদেশে পাচার করা হয়। দেশব্যাপী তাদের দালাল চক্র রয়েছে। দালালদের মধ্যে বগুড়ায় কামরুল, চট্টগ্রামে এনামুল, ঢাকায় আবুল হোসেন, খুলনায় নুরুল ইসলামসহ আরও অনেকের পরিচয় জানতে পেরেছে র‌্যাব। দেশে এই চক্রের মূলহোতা শাহিন খন্দকার। চক্রের সবাইকে গ্রেপ্তারের জন্য র‌্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে জানান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের কথা বলে জানা গেছে, এই চক্রের হোতাদের মধ্যে শাহীন খন্দকার একজন। তবে মূল হোতা সৌদি আরবের বাসিন্দা ফাহাদ নামক ব্যক্তি। তার সহযোগিতায় দেশ থেকে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারী পাচার করতো শাহীন খন্দকার। গ্রেপ্তারকৃত সীমা আক্তার মৌসুমী জানায়, আল-আতিক বিডি লিমিটেড নামক এই প্রতিষ্ঠানে চার মাসে আগে যোগ দেয় সে। মৌসুমী এবং শিল্পী আক্তার দুজনেই ওই অফিসের অভ্যর্থনাকারী হিসেবে কাজ করতো। শাহীনের নির্দেশ মতো ফোনে তারা শেখানো কথার বাইরে কোন তথ্য দিতেন না কাউকে। মৌসুমী জানান, বান্ধবী সানজিদার এক বন্ধুর মাধ্যমে শাহীনের সঙ্গে পরিচয়। পরে শাহীন তাকে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেন। মৌসুমীর বাড়ি হযরত শাহজালাল (র) বিমানবন্দর এলাকার হাজী ক্যাম্পে। তার পিতার নাম আনিসুর রহমান। শিল্পী আক্তারের বাড়ি চাঁদপুর জেলা সদরের রামদাশদি। একই এলাকায় বাড়ি ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার গ্রেপ্তারকৃত আবদুল লতিফের। অফিস সহকারী গ্রেপ্তারকৃত শহিদুলের বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদবেপুরের রনাইলে।

No comments

Powered by Blogger.