ট্রাস্টের অধীনে যাচ্ছে মনিপুর স্কুল

ঐতিহ্য হারাতে যাচ্ছে রাজধানীর মনিপুর স্কুল। ঐতিহ্যবাহী এ স্কুলটি ব্যক্তি-মালিকানায় ট্রাস্টের নামে পরিচালিত হওয়ার কাজ প্রায় সম্পন্ন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও গভর্নিং বডির সভাপতি কামাল মজুমদারের নামে হচ্ছে এ ট্রাস্ট। এজন্য এমপিওসহ সরকারি অনুদান সারেন্ডার করার প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে শিক্ষক-কর্মচারীদের। এ নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে অসন্তোষ। ট্রাস্টের অধীনে যাওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে গত ৩০শে জুন শেওড়াপাড়া ক্যাম্পাসে ৬০০-এর অধিক শিক্ষকের মানোন্নয়ন পরীক্ষা নেয়া হয়। পদোন্নতির এ পরীক্ষা শিক্ষকদের চাকরি হারানোর ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করবে স্কুল কর্তৃপক্ষ- এমনটা ধারণা করছেন শিক্ষকরা। তবে এ ট্রাস্ট গঠন নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ ট্রাস্টের অধীনে যাওয়ার আগে স্কুলের সব দাতা সদস্যের সম্মতি লাগবে। এ সম্মতি নিয়েই তৈরি এ জটিলতার।
শিক্ষকরা জানান, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী মনিপুর স্কুলটি পুরোপুরি নিজের কব্জায় নিতে ট্রাস্ট গঠন করতে যাচ্ছেন এমপি। শিক্ষকদের অভিযোগ, নানা সময়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করে এর প্রমাণও পেয়েছে। এসব অভিযোগ এবং জবাবদিহিতা এড়াতে সরকারি বেতন-ভাতা এমপিও সারেন্ডার করার কথা বলছে। ঢাকা বোর্ডের কলেজ শাখার তথ্য মতে, রাজধানীর নটর ডেম কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপ্রারেটরি স্কুল, সেন্ট জোসেফ, সিটি কলেজ এবং হলিত্রুস কলেজ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হয়। তবে এর মধ্যে নটর ডেম, সেন্ট জোসেফ ও হলিক্রস মিশনারির অধীনে নিয়ন্ত্রিত। সিটি কলেজও নিজেদের হিসাব না দেয়ার জন্য এমপিও সারেন্ডার করে ট্রাস্টের অধীনে চলে যায়।
ওদিকে চাকরি বাঁচাতে পরীক্ষা দিয়েছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের প্রায় ৬০০ শিক্ষক। নবীন-প্রবীণ সব শিক্ষকের এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষকদের জানিয়ে দেয়া হয় এ পরীক্ষায় পাস করলে চাকরি টিকবে, নইলে বিদায় নিতে হবে। ৩০শে জুন বিকাল সাড়ে তিনটায় শেওড়াপাড়া ব্রাঞ্চে পরীক্ষা হয়। জানা গেছে, টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট টেস্ট নামে এ পরীক্ষায় শিক্ষকদের শেষ ডিগ্রিতে অধ্যয়নের বিষয়ভিত্তিক (লিখিত) ৮০ নম্বর ও সাধারণ জ্ঞানের ২০ নম্বরের প্রশ্ন করা হয়। সৃজনশীল, বহু নির্বাচনী, এক বাক্যে ও এক কথায় উত্তর এবং সনাতনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মাউশি (মাধ্যমিক) পরিচালক এলিয়াস হোসেন বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন কোন পরীক্ষা নেয়ার বিধান নেই। আর কোন স্কুল তা নিতে পারেও না। যদি কোন শিক্ষক কোন বিষয়ে দুর্বল থাকেন তাহলে তার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। আর প্রশিক্ষণের বিষয়ও হতে হবে তিনি যে বিষয়ে পড়ান তার ওপরই।
এদিকে কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট টেস্টের নামে এ পরীক্ষা নেয়া হলেও প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলটির একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার ট্রাস্ট করার চিন্তা করছেন। এজন্য বারবার শিক্ষকদের এমপিও সারেন্ডার করার উদ্যোগও নিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে রাজি হননি। সে কারণে এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরীক্ষার মাধ্যমে চাপে ফেলে ট্রাস্টের পক্ষে কথা বলতে বাধ্য করতে এমন অভিনব পরীক্ষা নেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আর্থিক, নিয়োগসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণ পেলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১০-১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দফা অডিট করে বড় ধরনের আর্থিক ও নিয়োগ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এ ছাড়া ভর্তি ও ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগে হাইকোর্টের নির্দেশে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের এমপিও স্থগিত রয়েছে। এসব অভিযোগ থেকে রেহায় পেতে ট্রাস্টের অধীনে যাওয়ার পরিকল্পনা করে প্রতিষ্ঠানটি গভর্নিং বডি। সে লক্ষ্যে স্কুলের সিনিয়র ৬ জন শিক্ষককে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। এ কমিটি গত মাসে রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টের আলোকেই প্রতিষ্ঠানটি ট্রাস্টের অধীনে যাওয়ার সব কার্যত্রুম প্রায় চূড়ান্ত বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি তো ট্রাস্ট্রের জন্য গঠিত কমিটিতে ছিলেন, এমন প্রশ্নে তিনি কোন জবাব দেননি। মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাস্ট গঠন করে মূলত প্রতিষ্ঠানটির ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিতে চান বর্তমান গভর্নিং বডি। এ ছাড়া ট্রাস্টের অধীনে গিলে সরকারকে কোন জবাবদিহিতা করতে হবে না।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান যদি সরকারি অনুদান বা এমপিও না নেয় সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তবে প্রতিষ্ঠানটি কেন এমপিও নেবে না তা তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) পরিচালক প্রফেসর মফিজউদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কেউ অনুদান না নিলে এতে সরকারের লাভ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কেন নিচ্ছে না তা তদন্ত করে দেখার দরকার। তিনি বলেন, মনিপুর স্কুলে ডিআইএ তদন্ত করে কয়েক দফা কয়েক কোটি টাকা আর্থিক অনিয়ম ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতির নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটি যদি এখন নিজেদের এসব অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে ট্রাস্টের অধীনে চলে যায় তাহলে সরকারের কী বা করার আছে। জানা গেছে, মনিপুর স্কুলের বর্তমানে ৫টি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। এর মধ্যে মিরপুরে মূল ও কাজীপাড়া ছাড়া বাকি ৩টি শাখা অবৈধ। এর মধ্যে রূপনগর ব্রাঞ্চ, ইব্রাহিমপুর ব্রাঞ্চ এবং শেওড়াপাড়া ব্রাঞ্চের ভর্তিতে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এ ৫টি ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ও ১২০০ শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.