সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জবানবন্দি-১, মুসলিমদের প্রতি আমার কমিটমেন্টের কোন রাজনৈতিক সীমানা নেই

বাংলাদেশের রাজনীতির এক বহুল আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। কখনও কখনও বিতর্কিতও। সবসময়ই থেকেছেন আলোচনায় আর নজরদারিতে। সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়েও তার মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ই জুন থেকে শুরু করে নয় কার্যদিবস আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। ইংরেজিতে দেয়া সেই জবানবন্দির সময় ট্রাইব্যুনালে ঘটেছে নানা ঘটনা। সেই জবানবন্দির প্রথম দিনে তিনি বলেন, আমার নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জন্ম ১৩ই মার্চ ১৯৪৯। আমার কাজিনদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাঈনুর রেজা চৌধুরী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ফজলে করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমান প্রমুখ। আমার বাবার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার সূত্রেই আমি এ মামলার আসামী হয়েছি। তাই তার ব্যাপারেতো বিস্তারিত বলতেই হবে। এখানে একজন প্রফেসর সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন যিনি ৪০ বছর ধরে নিজের জন্মস্থান নিয়ে মিথ্যা বলছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯১৯ সালের ২৬শে মার্চ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল, বরিশাল বিএম কলেজ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে। মেধাবি এবং এলিট পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে হোস্টেলে থাকতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী দুই বার ওই হোস্টেলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। ফর্মাল চার্জে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তার প্রতিটি লাইনের জবাব আমি দিবো। তারা নবাব সিরাজউদ্দোলা থেকে শুরু করেছেন আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি আমি সিরাজউদ্দৌলার আগে যাবো না।
আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ফর্মাল চার্জে বলা হয়েছে, দ্বিজাতি তত্ত্বের কারণে উপ-মহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। এ বক্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অবমাননাকর। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ২৮৮ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে দ্বিজাতি তত্বের প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ, তীতিক্ষার বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসিকিউশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তা বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব। এটা খুবই প্রলুব্ধকর। বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে অন্য কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের লংঘন। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত পূর্ব-পাকিস্তানের সীমানাই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা। আর বাংলাদেশের বিচারপতিদের সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হয়েছে। দেশে ফেরার তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মিত্র বাহিনীর সদস্যদের দেশ ত্যাগ করিয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের মহত্তম এক ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপান যা করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু তা করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে আমি এ মামলার আসামী হয়েছি। আজ চাচার (বঙ্গবন্ধু) বই নিয়ে এসেছি। আমার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার কি সম্পর্ক ছিলো? আমি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কে তাতো এখানে বলতেই হবে। আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষার জন্যই এখানে লড়াই করছি না আমি আমার মর্যাদা রক্ষার জন্যও এখানে লড়াই করছি। ৩৩ বছর ধরে সংসদে আছি। ছয় বার জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। সংবিধাান ২ অনুচ্ছেদের ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থা স্থাপন করেই আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করি। (যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে- ক) ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভুত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদবহির্ভুত।) এ সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। ২ অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার  ভিত্তিতে নির্ধারিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সীমানাকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতি সুনিশ্চিতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গিকার প্রকাশ পায়। প্রসিকিউশন দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা দ্বিজাতি তত্বের প্রতি একধরনের বিদ্রুপ। যে তত্ত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
এ প্রস্তাব বাংলাদেশকে বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এ বক্তব্যে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমনসহ প্রসিকিউটররা বলতে থাকেন, এটা যাবে না। জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, এটা আমার বক্তব্য। আপনারা আপনাদের যুক্তির সময় জবাব দিবেন। এসময় প্রসিকিউটরদের সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম তর্কে জড়ান। ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, সালাউদ্দিন কাদের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। তিনি সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে বলছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বলছেন। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, সিকিমাইজেশন বললে এত গা জ্বলে কেন। এসময় ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব কথাগুলো জবানবন্দি থেকে বাদ দেয়া হয়। পরে সালাউদ্দিন কাদের তার জবানবন্দিতে বলেন, এ প্রস্তাব বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব তা আমি বলতে চাই কিন্তু কিছু লোক তাতে আহত (বিরক্ত) হবেন তাই আমি তা বলছি না। দ্বিজাতি তত্বের সুবিধা ভোগী কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আইনজ্ঞ যাদের নাম আমি স্মরণ করতে পারি তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সাত্তার, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ আরও অনেকের কথা। যারা প্রত্যেকে আমাদের জাতির জন্য গর্ব। এ বক্তব্যের ব্যাপারে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, দ্বিজাতি তত্ত্ব আমাদের জন্য কিভাবে সুফল বয়ে এনেছে তা বুঝানোর জন্যই এটা বলা প্রয়োজন। আমাদের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে নিয়েও আমি গর্বিত। তিনিও দ্বিজাতি তত্ত্বের ফসল। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক তার নিজের সম্পর্কে বর্নণা করেছেন এভাবে, সংস্কৃতিগতভাবে মুসলিম, শিক্ষাগত দিক থেকে ইংরেজ এবং দুর্ভাগ্যজনিত জন্মগত কারণে হিন্দু। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি জন্মসূত্রে চট্টগ্রামী। এটা কোন দুর্ঘটনা নয়। চট্টগ্রাম কখনওই নবাব সিরাজউদ্দোলার শাসিত অঞ্চলের অংশ ছিল না। আমি সিরাজউদ্দৌলাকে স্বীকার করি না। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ। আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। ওইদিন মধ্যহ্ন বিরতি শেষ হওয়ার আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পরিবারের সদস্যরা যেন তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি চান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সোমবারই তো পরিবারের সদস্যরা আপনার সঙ্গে দেখা করেছেন। তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমিতো তা অস্বীকার করছি না। এজন্য আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে কৃতজ্ঞ। ফাঁসির আসামীর সঙ্গেও পরিবারের সদস্যরা মাসে একবার দেখা করতে পারে। এসময় ট্রাইব্যুনাল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার অনুমতি দেন। বিরতির পর দেয়া সাক্ষ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ অঞ্চলের মুসলিমদের ওপর পরিচালিত নির্যাতনের বর্ননা দেন। তিনি বলেন, সারা দুনিয়াতেই এখন মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলছে। সোমালিয়া, বসনিয়া, গুজরাট, ফিলিস্তিন সারা দুনিয়ায় এখন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার। তিনি বলেন, মুসলিমদের প্রতি আমার কমিটমেন্টের কোন রাজনৈতিক সীমানা নেই।

No comments

Powered by Blogger.