৬৮ বছর পর মানচিত্রের অংশ

ছিটমহল বিনিময়ের আনন্দে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের
বাঁশকাটা ছিটমহলে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়
বাংলাদেশ এবং ভারতের মানচিত্রে দীর্ঘ ৬৮ বছর পর যাঁরা ছিলেন অস্তিত্বহীন, সেই ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫১ হাজার মানুষ এখন নিজ নিজ পছন্দের দেশের নাগরিক। যত দিন বেঁচে থাকবেন, এসব মানুষ তো বটেই, তাঁদের উত্তরাধিকারদের কাছে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত হবে বিশেষ এক দিন। কাঁটাতারের কোনো বেড়া ছিল না, ছিল না সীমানা পিলার। অথচ এক দেশের মানুষ হয়েও তাঁদের বসবাস করতে হয়েছে অন্য দেশের ভূখণ্ডে। দেশহীন, নাগরিকত্বহীন ‘ছিটের মানুষ’দের জীবনযাপনের কষ্ট, যাতায়াত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার কষ্ট, নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতার আজ অবসান ঘটতে চলেছে।
ছিটমহলগুলোর ইতিহাস মোগল আমলের রাজন্যবর্গের খামখেয়ালিপনা অথবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের নির্মম পরিণতির প্রতীক। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশের বিভক্তির পর ব্রিটিশ আইনজীবী সেরিল র্যাডক্লিফকে সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই বছরের ৮ জুলাই ভারতে এসে ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন, তার অনুসরণে ১৬ আগস্ট প্রকাশ করা হয় ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র। হুটহাট এ ধরনের সীমান্ত নির্ধারণে ছিটমহলের মানুষগুলোর ভাগ্য ঝুলে থাকে। তাঁরা রয়ে যান মানচিত্রের বাইরের মানুষ হিসেবে।
সীমান্তের এই জটিলতা অবসানের জন্য ১৯৫৮ সালে সই হয় নেহরু-নুন চুক্তি। ওই চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি।
১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি সই হয় বিষয়টি সুরাহার জন্য। বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তা না করায় চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। কিন্তু ওই চুক্তিও আলোর মুখ দেখেনি।
চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকলে সই করেন। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ভারতের সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাসে ব্যর্থ হয়। এবার নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত মে মাসে সর্বসম্মতভাবে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৪১ বছরের অপেক্ষার।
এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৮ সালে সই হওয়া নেহরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়।
ছিটমহল বিনিময়ের পাশাপাশি ’৭৪-এর সীমান্ত চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে অপদখলীয় জমি বিনিময় ও সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার কথা রয়েছে। আর ২০১১ সালে সই হওয়া প্রটোকল অনুযায়ী ছিটমহল বিনিময়ের পাশাপাশি অপদখলীয় জমি ও সীমানা চিহ্নিত করার কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে এ বিষয় দুটির চূড়ান্ত সমাধান হবে। অর্থাৎ অপদখলীয় জমি বিনিময় ও অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিত করে স্থলসীমান্ত চূড়ান্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশীর মানচিত্রের।
পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নতুন করে ১০ হাজার একরের বেশি ভূমি যুক্ত হবে। আবার অপদখলীয় জমি বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ২ হাজার ৭৭৭ একর জমি ভারতকে এবং ভারত ২ হাজার ২৬৭ একর জমি বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত অতিরিক্ত ৫১০ একর জমি পাবে।
চূড়ান্তভাবে কোন দেশের কত ভূমি নতুন করে যুক্ত হলো, সে ব্যাপারে দুই দেশ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।
গত শুক্রবার বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের (আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর) বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর) ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ১৬২ ছিটমহলে ৫১ হাজার ৫৪৯ অধিবাসীকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় বাংলাদেশে অবস্থিত ছিটমহলগুলোতে বাস করে এবং ১৪ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি ভারতের ছিটমহলগুলোতে বাস করে।
এসব লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলের ৯৭৯ জন ভারতে ফিরে যেতে চান। তবে তাঁদের রাতারাতি ভিটে ছাড়তে হবে না। সীমান্ত চুক্তি প্রটোকল অনুযায়ী যাঁরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফিরতে চান, এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে তাঁদের চলে যেতে হবে। ওই সময়ের আগ পর্যন্ত তাঁদের স্থানীয় প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের ছিটমহলের অন্য লোকজন যে যেখানে আছেন, সেখানেই থেকে যাবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের যেসব ছিটমহল এখন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগের অবস্থান দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসব ছিটমহলের ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে চারটি। অন্যদিকে ভারতে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর ৪৭টি পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, দুই দেশের জন্য ৩১ জুলাই একটি ঐতিহাসিক দিন। এখন থেকে সীমান্তের দুই পাড়ের ওই লোকজন যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকত্ব ভোগ করবেন। দুই দেশের সরকার এসব লোকজনের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।
ছিটমহলবাসীর নাগরিক সুবিধা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের পর সেখানকার লোকজনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তাঁদের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার এবার বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রেখেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখান থেকে তাঁদের জন্য অর্থ খরচ করা হবে। এ কাজটি করার জন্য জেলা প্রশাসকদের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এই ‘নতুন নাগরিক’দের দোরগোড়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা কীভাবে এবং কবে নাগাদ পৌঁছানো হবে, সেই পরিকল্পনার বিষয়ে জেলা প্রশাসন সূত্রে বিস্তারিত জানা যায়নি।
ছিটমহল বিনিময়ের পর কোনো পরিবারের বাংলাদেশে থেকে যাওয়া সদস্য যদি ভারতে বা ভারতে থেকে যাওয়া সদস্য বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজনে তাঁর স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে চান, সে ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ পাস দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে শহীদুল হক আরও বলেন, এমন কোনো পাস দেওয়া হবে না। স্বাভাবিক নিয়মে ভিসা নিয়ে দেখা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.