নাগা চুক্তির শর্ত নিয়ে ধোঁয়াশা

ভারত সরকারের সঙ্গে গতকাল সোমবার ঐতিহাসিক চুক্তি হয়েছে নাগা বিদ্রোহীদের। এর মাধ্যমে ছয় দশকের রক্তপাতের অবসান ঘটতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে চুক্তিটি হয়েছে একটি বিদ্রোহীদের একটি পক্ষের সঙ্গে, আবার চুক্তির শর্তগুলোও স্পষ্ট করা হয়নি। এতে চুক্তিটি কতটা বাস্তবে রূপ নিতে পারবে, তা নিয়ে আজ মঙ্গলবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের নাগারা। কখনো প্রকাশ্যে, কখনোবা লোক চোখের আড়ালে এই রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছিল। প্রাণহানি ঘটেছে বহু মানুষের। এই রক্তক্ষয়ী অবস্থা থেকে পরিত্রাণে লড়াইরত নাগাদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাতে ১৯৯৭ সাল থেকে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়। এর সুফল মিলেছে গতকাল। সরকার ও নাগা বিদ্রোহীরা একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছে।
ভারত সরকারের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের ইসাক-মুইভাহ গ্রুপের (এনএসসিএন-আইএম) শান্তি চুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারি বাসভবন রেস কোর্স রোডের ৭ নম্বর বাড়িতে তাঁর ও এনএসসিএনের (আইএম) প্রধান থুইংগালাং মুইভার উপস্থিতিতে শান্তি চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করে বলেন, ‘নাগাল্যান্ডের রাজনৈতিক এই ইস্যুটি ছয় দশক ধরে ঝুলে ছিল। এ সময় আমাদের কয়েক প্রজন্মকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘নাগা সমস্যা সমাধানে দীর্ঘ সময় লাগল। কারণ আমরা পরস্পরকে বুঝতে পারিনি।’ আর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মুইভা প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করে বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির অধীনে আমরা পরস্পরকে বুঝতে পেরেছি এবং এবং দুই পক্ষের মধ্যে নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।’
শান্তি চুক্তি নিয়ে যে পরিমাণ উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা হচ্ছে, শান্তি চুক্তির শর্ত নিয়ে তেমন কোনো কথা হচ্ছে না। শর্তগুলো এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তাই শর্ত নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। তবে চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, টেকসই সমাধানের লক্ষ্য নিয়েই চুক্তিটি হয়েছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে এই সমঝোতা প্রক্রিয়ার প্রতি মনোযোগ রাখছিলেন। চুক্তিটির ফলে সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উন্নয়ন কাজ শুরুর আশা করছে। নাগাদের সশস্ত্র লড়াইয়ে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, যা উন্নয়নকে আটকে দিয়েছে।
শান্তির পথে অন্যতম বড় বাধা হতে পারে একটি বিষয়। সেটি হলো, নাগা বিদ্রোহীরা মণিপুর রাজ্যের নাগা-ভাষাভাষীদের এই চুক্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। তবে সরকার বিষয়টির সঙ্গে একমত হয়নি বলে সূত্রগুলো বলছে। চুক্তির শর্তগুলো স্পষ্ট করা না হলেও দুই পক্ষ একসঙ্গে বসে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া এই চুক্তির সঙ্গে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (এনএসসিএন-খাপলং) অংশটিকে যুক্ত করা হয়নি। এই অংশের প্রধান এস এস খাপলং একজন বার্মিজ নাগা। তিনি ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যেতে চান না। ভারত সরকারকে পাশ কাটিয়ে একতরফাভাবে ২০১২ ও ২০১৫ সালের মার্চে এনএসসিএন (খাপলং) মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে স্বাক্ষর করে। এনএসসিএন (খাপলং) পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সঙ্গেও মিলেমিশে কাজ করে। এ ছাড়া গত কয়েক মাস ধরে এনএসসিএন (খাপলং) ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ক্রমাগত হামলা চালিয়েছে। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়েছে। দুর্নীতি, অর্থ লুটপাট, অপহরণ সাম্প্রতিক সময়ে নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চুক্তির সাফল্য নিয়ে সংশয় দেখা দিতেই পারে।
তবে চুক্তিটির ফলে নাগাল্যান্ডের তরুণ প্রজন্ম ভারতের মূলধারার সঙ্গে মিলে যাওয়ার সুযোগ পাবে। এনএসসিএন-আইএমের মুইভাহর ব্যক্তিগত অর্জনও কম হবে না। বিদ্রোহীর বদলে শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়ার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন। চুক্তিটি ভারত-মিয়ানমার সম্পর্কের জন্য লাভজনক হবে। কারণ, এত দিন নাগা বিদ্রোহীরা চীনের কারখানা থেকে মিয়ানমার-চীন সীমান্ত ব্যবহার করে অস্ত্র এনে ভারতের বেসামরিক-সামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে।

No comments

Powered by Blogger.