খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা: বাদীকে তিন ঘণ্টা জেরা

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের তারিখ ১০ই আগস্ট ধার্য করেছেন আদালত। রাজধানীর বকশীবাজারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ তারিখ ধার্য করেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতির দুই মামলায় হাজিরা দিতে গতকাল আদালতে উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়া। বিশেষ জজ আদালত-৩-এর অস্থায়ী এজলাসে এই দুই মামলার বিচারকাজ চলছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদকে টানা তিন ঘণ্টা জেরা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। পরে তিনি জেরা সমাপ্ত ঘোষণা করেন। সাক্ষীকে মামলার অপর দুই আসামির পক্ষে জেরা এখনও বাকি আছে। জেরা শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ২৬শে আগস্ট বার কাউন্সিল নির্বাচন হওয়ায় ওই তারিখের পর মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের দিন ধার্য করতে আবেদন করেন। এর বিরোধিতা করে বাদীপক্ষের আইনজীবী  মঙ্গলবার মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্যের আবেদন জানান। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের তারিখ ১০ই আগস্ট ধার্য করেন আদালত। এর আগে গুলশানের বাসভবন থেকে রওনা হয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছান খালেদা জিয়া। তার হাজিরাকে কেন্দ্র করে আদালত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এর আগে গত ২৩শে জুলাই এই মামলার শুনানিতে খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন বিচারক মামলার পরবর্তী শুনানি ৩রা আগস্ট ধার্য করেন।
বাদীকে জেরার বিস্তারিত
খন্দকার মাহবুব হোসেন-চ্যারিটেবল ট্রাষ্টে অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে কোন লিমিট ছিল না। কিন্তু আপনি বলেছেন ডোনেশন নেয়ার লিমিট ছিল।
বাদী- জি
মাহবুব-ট্রাস্টের অবজেক্টিভে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দুস্থ রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মী, দুঃস্থ ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার বিষয়টিও উল্লেখ করা আছে
বাদী- জি, উল্লেখ আছে।
মাহবুব- সংবাদপত্রে কাজ করে এবং কাজ করে না অথচ সাংবাদিক এমন ব্যক্তিদেরও সাহায্য করা যাবে এ বিষয়টিও আছে।
বাদী- জি
মাহবুব- উদ্দেশ্য পূরণের জন্য চ্যারিটেবলের নামে জমি, দালানকোঠা কেনা যাবে।
বাদী-জি, উল্লেখ আছে।
মাহবুব- ট্রাস্টে যদি কোন ধরনের অনিয়ম হয় বা অযোগ্যতা, অদক্ষতার কারণে যদি চ্যারিটেবল অক্ষম হয় তাহলে ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
বাদী- ট্রাস্টি করতে পারবেন বলা আছে।
মাহবুব- রাজনৈতিক দলের ফান্ড কিভাবে পরিচালিত হয় আপনি জানেন।
বাদী- দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়।
মাহবুব- বিএনপির ফান্ড কার দস্তখতে, কিভাবে ব্যবহার করা হয় অনুসন্ধান করার সময় তা দেখেছেন?
বাদী- দেখেছি।
মাহবুব- কোন কাগজপত্র জব্দ করেছেন কি।
বাদী- সংগ্রহ করেছি। জব্দ করিনি।
মাহবুব- তখন দলের প্রধান কে ছিলেন।
বাদী- সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
মাহবুব- সাধারন সম্পাদক কে ছিলেন।
বাদী- মরহুম আবদুল মান্নান ভুঁইয়া।
মাহবুব- দলের নামে কয়টা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল।
বাদী- ৭টি অ্যাকাউন্ট ছিল।
মাহবুব- এসব অ্যাকাউন্টে লেনদেন করতে কে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল। কার দস্তখত লাগতো।
বাদী- একেকটি অ্যাকাউন্টের জন্য একেকজনকে ক্ষমতা দেয়া ছিল।
মাহবুব- প্রতি বছর দলের বার্ষিক হিসাব-নিকাষ নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হতো।
বাদী- আগে এসব ছিল কি না জানা নেই। সম্প্রতি এটা হয়েছে।
মাহবুব- এক্ষেত্রে দলের ফান্ড নিয়ে কোন অনিয়ম হয়েছে কি না তা এই মামলার বিষয় নয়।
বাদী- কোন অনিয়মের কথা বলিনি।
মাহবুব- এই মামলা যখন করেন তখন আপনার পদবি কি ছিল।
বাদী- সহকারী পরিচালক।
মাহবুব- আজকে সাক্ষী দিচ্ছেন কোন পদে থেকে।
বাদী- উপপরিচালক।
মাহবুব- আপনার ভাগ্য ভাল, এই মামলার পর আপনার পদোন্নতি হয়েছে।
বাদী- আমার একার পদোন্নতি হয়নি। একসঙ্গে ৩০ জনের পদোন্নতি হয়েছে।
মাহবুব- এটা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছিল।
বাদী- এটা শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ছিল।
মাহবুব- চ্যারিটেবলের বাংলা যদি দাতব্য প্রতিষ্ঠান বলি তাহলে কি ভুল হবে।
বাদী- বলতে পারেন।
মাহবুব- চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জন্য কার কাছ থেকে দান গ্রহণ করা হবে বা হবে না এমন কোন বিধান বা বিধিনিষেধ আছে।
বাদী- জানি না।
মাহবুব- দানের অংশের কোন নির্দিষ্টতা নেই। যার যা সামর্থ্য দিতে পারেন।
বাদী- জানা নেই।
মাহবুব- বোর্ড অব ট্রাস্টির মেম্বার হতে হলে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
বাদী- জানা নেই। যিনি ডোনার তিনিই মেম্বার অব ট্রাস্টি
মাহবুব- ট্রাস্ট ফান্ডে টাকা এসেছে দুই খাত থেকে। একটি দলীয় ফান্ড ও অপরটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে।
বাদী-জি।
মাহবুব- ট্রাস্ট ফান্ড থেকে যে লেনদেন হয়েছে তা পে-অর্ডারের মাধ্যমে হয়েছে
বাদী-জি। টাকা দেয়ার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চেকে ইউরসেলফ লিখে ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে দিয়েছেন। তারপর ম্যানেজার পে-অর্ডার করেছেন।
মাহবুব- আপনি কখনও পে-অর্ডার করেছেন।
বাদী-জি।
মাহবুব- কিভাবে করতে হয় জানেন।
বাদী- চেক দিতে হয়। তারপর ফরম পূরণ করতে হয়।
মাহবুব- ফরম পূরণ করতে গিয়ে যে দিচ্ছেন তার স্বাক্ষর লাগে।
বাদী- আবার কেউ যদি ইউরসেলফ লিখে দেয় সেটা ম্যানেজার করতে পারেন।
মাহবুব- ইউরসেলফ লিখে যে চেক দেয়া হয়েছে সেটাই পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকায় পরিণত হলো।
বাদী-জি।
মাহবুব- ২টি পে-অর্ডার একই পদ্ধতিতে হয়েছে।
বাদী- জি। ২টি পে-অর্ডার জমি কিনতে দেয়া হয়।
মাহবুব- চেক ২টি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
বাদী- জি।
মাহবুব- চেকগুলো বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করা হয়েছে।
বাদী- জি।
মাহবুব- এখানে কোন স্প্রিড মানি পেয়েছেন কি
বাদী-প্রশ্ন বুঝি নাই।
মাহবুব-ইউরসেলেফ চেকটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কি না
বাদী- জি।
মাহবুব- যখন মামলাটি করা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়।
বাদী- আগে বলা হয়েছে।
মাহবুব- এই মামলাটি করার জন্যই আপনাকে প্রমোশন দিয়ে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বাদী- এটা সত্য নয়। আমি তো একা পদোন্নতি পাইনি। আরও ৩০ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
মাহবুব- জমিটা দেখেছেন।
বাদী- জি, দেখেছি।
মাহবুব- জমির দাম বাবদ কত টাকা দেয়া হয়েছে।
বাদী- ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার টাকা। স্থাপনার দাম ৩ লাখ। মোট ৬ কোটি ৫২ লাখ ৭ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও জমির দাতাকে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
মাহবুব- জমিটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে কেনা হয়েছে।
বাদী- জি।
মাহবুব- জমির বিক্রেতা ওই টাকা পেয়েছেন।
বাদী- জমি ও স্থাপনার দামসহ অতিরিক্ত টাকা পেয়েছেন।
মাহবুব- জমিটি যখন কেনা হয় তখন জমির কি অবস্থা ছিল তা আপনি জানেন না।
বাদী- জানার কথাও না।
মাহবুব- জমির মালিক ভদ্র মহিলার স্বামী মারা যান। তিনি বিধবা হিসেবে জমিটি বিক্রি করেছেন।
বাদী- জি।
মাহবুব- জমিতে অবৈধ কিছু দখলদার ছিল।
বাদী- আমি জানি না।
মাহবুব- অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করতে হলে বাংলাদেশে প্রচলিত দুটি পদ্ধতি আছে। একটি লাঠি আরেকটি টাকা।
বাদী- এ নিয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।
মাহবুব- অতিরিক্ত টাকা জমির মালিককে দেয়া হয়েছে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে জমিটি উদ্ধার করতে।
বাদী- এটা জানা নেই। দলিলেও কিছু নেই।
মাহবুব- জিয়াউর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল এ কথার প্রেক্ষিতে আপনি বলেছিলেন ইহা সত্য নয়। জিয়ার আদর্শ ছিল- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার শোষণমুক্ত সমাজ।
বাদী- ট্রাস্টের উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যায় যেসব কথা লেখা রয়েছে তাতে এসব নেই।
মাহবুব- এসব করতে হলে যে অবজেক্টিভ দরকার তা উল্লেখ আছে।
বাদী- জি।
মাহবুব- এখানে কোন সরকারি অর্থের লেনদেন হয়নি।
বাদী- খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ট্রাস্টে তিনি পরিচয় গোপন করেছেন। একইসঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তার বক্তব্যে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা প্রতিবাদ জানান। আদালত কক্ষে কিছু সময়ের জন্য উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মাহবুব- রাজনৈতিক হেয় ও হয়রানি করতে এ মামলা করা হয়েছে।
বাদী- ইহা সত্য নয়। কারণ এটা কোন ব্যক্তিগত ট্রাস্ট নয়।
মাহবুব- বাংলাদেশে আদর্শ বাস্তবায়নে হাজার হাজার ট্রাস্ট ও ট্রাস্টি আছে। এগুলো করা হয় সমাজসেবা ও মানবিক কারনে। যিনি করেন তাতে তার নাম-ঠিকানা উল্লেখ থাকে।
বাদী- জি থাকে। তবে তার প্রধানমন্ত্রী পরিচয় গোপন রাখা হয়।
মাহবুব- দুদক আইনের যে বিধান আছে তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জনসম্মুখে হয়রানি ও হেয় প্রতিপন্ন করতে এ মামলা করা হয়েছে।
বাদী- ইহা সত্য নয়।
এ পর্যায়ে প্রথমে মাহবুব হোসেন বলেন, বাদী হিসেবে তাকে জেরা করা শেষ হয়েছে। পরে খালেদা জিয়া ও অন্যান্য আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি বিচারককে বলেন, তাকে আবারও জেরা করতে চায়। এ সময় বিচারক বলেন, বাদী একইসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। জেরায় আপনাদের যদি কোন বিষয়ে গ্যাপ থাকে তখন জেরা করে ঠিক করে নিয়েন। এরপরই বাদী হিসেবে তাকে জেরা শেষ বলে ঘোষণা দেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।
মামলার তারিখ নিয়ে বিতর্ক
জেরা শেষে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলার পরবর্তী তারিখ নিয়ে আদালতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ২৬শে আগস্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচন। ৩ বছর পর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সারা দেশে ৭৩টি বার অ্যাসোসিয়েশনের ৪৫ হাজার আইনজীবী অংশ নেবেন। নির্বাচনের পর ২ দিন বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন। এতে আমাদের সবার জন্য সুবিধা হবে। বাদী পক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, এ মামলার অন্য আসামির আইনজীবী বলেছেন সুইটেবল শর্টটাইম দেয়ার জন্য। আমার মনে হয় আগামীকাল দিন নির্ধারণ করাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। এ সময় বিচারক বলেন, ২০১৪ সালের ২২শে ডিসেম্বর এ আদালতে বিশেষ জজ হিসেবে যোগ দিয়েছি। এখানে ৮৭টি দুদক মামলা বিচারাধীন। ৪১টি স্টে আছে। আমরা যারা স্পেশাল জজ তারা আইন ও প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা দেখা ছাড়া আর কিছু দেখার সুযোগ নেই। দুদকের সব মামলা সপ্তাহভিত্তিক তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আপনারা আলোচনা করে ঠিক করে নিন সপ্তাহের কোন দিন এ মামলার তারিখ নির্ধারণ করা হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্যর দুর্নীতি মামলা এ আদালতে এসেছে। তার ক্ষেত্রে এক সপ্তাহর মধ্যে তারিখ দেয়া হয়েছে। পরে বিচারক আবারও বাদী ও আসামি পক্ষের আইনজীবীর শুনানি শুনে আগামী ১০ই আগস্ট সোমবার মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন। একইসঙ্গে ৫ সাক্ষীকে ওই দিন হাজির থাকার নির্দেশনা দেন।

No comments

Powered by Blogger.