অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের মতো দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরুন by পীর হাবিবুর রহমান

উন্নয়নের চাকা ঘুরালেও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের যে স্বীকৃতি দিয়েছে তা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শতাধিক দেশ রয়ে গেছে, স্বল্প-উন্নত দেশের কাতারে থেকে ৫০-৬০ বছর ধরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। বাংলাদেশকে তাই এই অর্জন ধরে রেখে সুশাসন নিশ্চিত করে শিক্ষা স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলে মধ্যম আয়ের সিঁড়ি টপকে দেশকে আরো উঁচুতে নিয়ে যেতে হবে। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার সরকার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের মতো ছুটলেও দুর্নীতির ঢেউ তৃণমূল পর্যন্ত আছড়ে পড়েছে। কমিশন, ঘুষ ও তদবিরের স্বর্ণযুগ চলছে। চাটুকারদের তেলবাজিতে স্বার্থ হাসিল, মধ্য স্বত্বভোগী দালাল, তদবির বাজিতে কমিশন খেয়ে বিত্তবৈভবের মালিক হচ্ছে। আমলা পাড়া থেকে রাজনৈতিক পাড়া, মন্ত্রী পাড়া থেকে এমপি পাড়া, পেশাদার টাউটদের সঙ্গে রাজনৈতিক পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহিলাকর্মীরাও আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমলা, প্রকৌশলী থেকে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতাদের অন্দরে তাদের যাতায়াত। ফাইল পাস, ফাইল     ছুটানো থেকে শুরু করে এমন কোনো তদবির নেই যেখানে তারা সফল হচ্ছেন না। অতি সাধারণ বেশভূষায় যারা গণপরিবহনে চলাফেরা করতেন তাদের এখন হাসের সোনার ডিম পাড়ার মতো জীবন। রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়ায় সিন্ডিকেট ঘরে ঘরে। নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাজি থেকে সর্বত্র হাত ডুবিয়ে টাকার খনি পাচ্ছেন। চেহারা বদলে যাচ্ছে, বেশভূষা বদলেছে, ফ্যাশনে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক, ঘড়ি, গহনাই গায়ে শোভা পাচ্ছে না, দামি গাড়ি হাঁকিয়ে পথ চলছেন। দেশে বিত্তবৈভব গড়ে, দেশের বাইরেও সম্পদ গড়ছেন। উন্নয়নের পাশাপাশি হরিলুট চলছে। সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সৎ, সাহসী মানুষ যখন বলেন, ‘আমাদের লোকদের জন্য ব্যাংক ডাকাতদের জেলে নিতে পারিনি’, তখন শেয়ার কেলেঙ্কারি থেকে ব্যাংকিং খাতের লুটপাট ও সারাদেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ থেকে দুর্নীতিবাজদের লুটের মহাৎসবের চিত্র ফুটে ওঠে।
সীমান্ত জেলা শহর সুনামগঞ্জের তিনটি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির চিত্র মহান সংসদে বারবার উঠে এলেও এটির তদন্ত যেমন হয়নি, তেমনি দুর্নীতির বরপুত্রদের হাতে আইনের কড়া পরানো যায়নি। এভাবে সারাদেশে উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির মহাৎসব চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, পাওয়ার গ্রিড সুনামগঞ্জ শহরের প্রবেশের মুখে বিদ্যুতের সাবস্টেশন বসানোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে জেলা প্রশাসনের সাবেক এক কর্মকর্তার সঙ্গে হাফ প্যান্ট পরা বয়সী এক যুবলীগ নেতা মাত্র ৬০ লাখ টাকার জমি কিনেছেন পাঁচ কোটি ছিয়ানব্বই লাখ টাকায়।
লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তিকে ৬০ লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা ভাগাভাগি করে পকেটে তুলেছেন। এই নিয়ে বারবার সংসদে অভিযোগ তুললেও তার তদন্ত হয়নি। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ কোটি টাকার দুইভাগ কাজ করে তিনভাগই ঢাকায় বসে স্থানীয় প্রকৌশলীদের সহায়তায় লুটে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। এ নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। তবুও তদন্ত নেই, ব্যবস্থা নেই। সুনামগঞ্জ সুরমা নদীতে ধোপাজান বালুপাথর মহালে নৌ শ্রমিকদের ওপর চাঁদাবাজি-জুলুম চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এখানেও সরকারি দলের একটি চক্র মুনাফা লুটছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায়। না হচ্ছে তদন্ত, না নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা। অথচ সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে শেখ হাসিনার সরকার এগারোটি নতুন ব্রিজ নির্মাণ করেছে। সুনামগঞ্জবাসীর বহুল প্রত্যাশা সুরমা সেতু নির্মাণ হয়েছে। এভাবে সারাদেশে অবকাঠামোর উন্নয়নসহ শিক্ষা স্বাস্থ্য বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। পাশাপাশি এসব জায়গায় দগদগে ঘায়ের মতো স্থানীয় মানুষদের গা জ্বলছে দুর্নীতি চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসায়। সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো নিয়োগ নিয়ে সেই নিয়োগ-বাণিজ্য এখনো চলমান।
ঢাকা জেলা পরিষদ প্রশাসকের বিরুদ্ধে ভুতুড়ে প্রকল্পের নামে কাজ না করিয়ে বরাদ্দের টাকা লুটপাট নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম। ব্যবস্থা নেয়ার যেন কেউ নেই। শুধু মন্ত্রী এমপি প্রশাসন নয় জেলা পরিষদের রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরাও অনেক জায়গায় বিতর্কের মুখে।
বিএনপি শাসনামলে আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তিনি তার দেশের ক্ষমতায়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠককালে মাহাথির মুজিব কন্যাকে বলেছিলেন, আপনার প্রথম পাঁচ বছর আমার পাঁচ বছরের চেয়ে উত্তম। কিন্তু আমরা সফল হয়েছি, কারণ নীতির পরিবর্তন যেমন ঘটাইনি তেমন দুর্নীতির লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এতটাই পরিশ্রমী যে, ১৯৯৬ সালে তার সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর অভিজ্ঞতা নিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছিলেন, ‘এই প্রধানমন্ত্রী কাজের জন্য অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের মতো ছোটেন। যেখানে আর কেউ তার সঙ্গে পা মেলাতে পারেন না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষিপ্রতা দেখে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মুজিবকন্যাকে ইলেক্টেড সিএম বলতেন। এখনো তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে ইবাদত বন্দেগি শেষে চায়ের কাপের সঙ্গে দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর পাঠ করে শেখ হাসিনা দিন শুরু করেন। তিনি ফাইলওয়ার্ক করেন, সই করেন এমনকি যে কোনো মিটিংয়ে যাওয়ার আগে হোমওয়ার্ক করে যান।
কোনো কোনো মন্ত্রী পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেন। তিনি সামাল দেন। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করা শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদেরও নিয়মিত সাক্ষাৎ দেন। পর্যবেক্ষকদের ভাষায়, টাকার অবমূল্যায়ন না হওয়া, ডলারের স্থিতিশীলতা, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবার ইতিহাসের রেকর্ড গড়াতেই বাংলাদেশ নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এখন দরকার দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরে শুধু গার্মেন্টস শিল্পই নয় রফতানি সামনে রেখে অন্যান্য শিল্প খাতকে শক্তিশালী ও বিকশিত করা। অন্যদিকে, বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ধনী ও গরিবের বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডক্টর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, তিনি কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে একজন মন্ত্রী ও তার বউ এতই তদবির করতেন যে, সেহরির সময়ও ফোন করে বসতেন। তিনি খুব বিরক্ত হতেন। তার প্রস্তাব যে কোনো ব্যাংকঋণে কোনো মন্ত্রী বা প্রভাবশালী কারো সুপারিশ বা তদবির থাকলে ঋণদানের সময় সেই ব্যক্তির নামটিও লিপিবদ্ধ করে রাখা দরকার। শুধু তাই নয়, অনেকেই ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মনে করেন, যে কোনো প্রতিষ্ঠানে মন্ত্রী এমপি বা রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা তদবির করলে তার নামটিও ফুটনোটে রাখা যেতে পারে। এতে তদবিরবাজরা নিরুৎসাহিত হবেন। উন্নয়নেই নয় দুর্নীতির লাগামটিও অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাক হর্সের মতো ধরতে হবে। না হয় সরকারের জন্য উন্নয়নের লড়াই পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.