১৪ বছর পর ফাঁসি থেকে রেহাই ‘শিশু’ শুক্কুর আলীর

প্রায় ১৪ বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেন ‘শিশু’ শুক্কুর আলী। ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) করে গতকাল সোমবার তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেন। আদালতে শুক্কুর আলীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম কে রহমান ও সারা হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে মামলার বাদীপক্ষের কেউ আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। সাত বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ২০০১ সালে শুক্কুর আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। ওই সময় থেকে তিনি কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী। তাঁর আইনজীবীরা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা করে দণ্ড কমানোর এমন ঘটনা দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিরল।
দীর্ঘ আইনি লড়াই: মানিকগঞ্জের শিবরামপুর গ্রামে সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে ১৯৯৯ সালে শুক্কুর আলীর বিচার শুরু হয়। তখন তাঁর বয়স ১৪। ২০০১ সালের ১২ জুলাই মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শুক্কুরকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
একটি শিশুকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ায় তার পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে শুক্কুর আলী। তার পক্ষে মামলা পরিচালনা শুরু করে ব্লাস্ট। ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান শুক্কুর আলী। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগেও তাঁর ফাঁসি বহাল থাকে। এরপর রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন শুক্কুর। ওই বছরের ৪ মে পুনর্বিবেচনার ওই আবেদনও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
বিচারিক আদালতে শুক্কুর আলীর বিচার হয়েছিল ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এই আইনে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে একমাত্র সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড। ২০০০ সালে তা রহিত করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
এরপর দুই আইনের এই তারতম্যের বিষয়টি তুলে ধরে শুক্কুর আলী ও ব্লাস্ট ২০০৫ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০১০ সালের ২ মার্চ হাইকোর্ট ১৯৯৫ সালের আইনের ৬ (২) ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, অপরাধ যা-ই হোক না কেন, মৃত্যুদণ্ড কোনো অপরাধেরই একমাত্র সাজা হতে পারে না। তবে এর আগে আপিল বিভাগ শুক্কুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখায় হাইকোর্ট তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবার আপিল বিভাগে যায় শুক্কুর আলী ও ব্লাস্ট। শুনানি শেষে গত ৫ মে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, ১৯৯৫ সালের আইনের ৬ (২), ৬ (৩) ও ৬ (৪) ধারা অসাংবিধানিক। এর মধ্যে দুটি ধারায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের সামনে রাখা হয়নি। তবে এখানেও শুক্কুরের ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
এরপর সর্বশেষ ওই রায়ের সাজার অংশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন শুক্কুর। গতকাল ওই পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।
আদেশের পর শুক্কুরের আইনজীবী এম কে রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা করে দণ্ড কমানোর ঘটনা আমার জানামতে এটাই প্রথম। উপমহাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসেও এটা বিরলতম একটি ঘটনা।’ তিনি আরও বলেন, মামলা হওয়ার সময় শুক্কুরের বয়স ছিল ১৪ বছর। ২০০১ সালের ১২ জুলাই থেকে সে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পুনর্বিবেচনার আবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালের আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়েই হয়তো আপিল বিভাগ সাজা কমিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.