নৃশংস- খুলনায় ১২ বছরের রাকিবকে কম্প্রেসার মেশিনে বসিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা

সিলেটের পর এবার খুলনা। নৃশংস, বর্বর কায়দায় খুন করা হলো আরেক শিশুকে। এবার পিটিয়ে নয়, খুনের কায়দা একেবারেই আলাদা। মলদ্বারে ইলেকট্রিক কম্প্রেসার দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে। ঘটনার শিকার ১২ বছরের দরিদ্র শিশু রাকিব। তার অপরাধ ছিল কর্মস্থল ত্যাগ করে অন্যত্র কাজ নেয়া! আর এ কারণে জঘন্য বর্বর কায়দায় হত্যাকারীরা রাকিবের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। শরীরে অতিরিক্ত বাতাস প্রবেশ করানোর ফলে তার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়া। এতে ঘটনার কিছু সময়ের মধ্যেই মারা যায় শিশু রাকিব। সিলেটে পিটিয়ে শিশু রাজনকে হত্যা ও এর দৃশ ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় যখন বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে ঠিক সেই সময়ে এমন নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। ঘটনার পর উত্তেজিত জনতা তিন খুনিকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় জনতা। সোমবার বিকালে নগরীর টুটপাড়া কবরখানা এলাকায় শিশুটির ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের পর রাত ১২টার দিকে রাকিবের মৃত্যু হয়। রাকিবের পারিবারিক সূত্র জানায়, কর্মস্থল ছেড়ে অন্য গ্যারেজে কাজ করার অপরাধে তাকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছে স্থানীয় শরিফ মোটর্স’র মালিক শরিফ ও তার সহযোগী মিন্টু। গুরুতর আহত অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানকার চিকিৎসকরা রাকিবকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। ঢাকায় নেয়ার পথে রাত ১২টার দিকে মারা যায় শিশু রাকিব। তার বাবা আলম হাওলাদার জানান, বিকালে গ্যারেজ মালিক শরিফ ও তার সহযোগী মিন্টু মিলে রাকিবকে ধরে তার মলদ্বারে মোটরসাইকেলের চাকায় হাওয়া দেয়ার পাইপ (কম্প্রেসার) ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাকিবের পেট ফুলে গেলে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে নির্যাতনকারী দুজনই রাকিবকে খুমেকে ভর্তি করে এবং তার পরিবারকে খবর দেয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাতাস প্রবেশ করানোর কারণে তার নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে যায় এবং ফুসফুস ফেটে যায়। এসব ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অর্গান অকেজো হয়ে যাওয়ায় সে মারা যায়।
রাকিবের বাবা আলম হাওলাদার ও খালা পারুল বেগম বলেন, খুমেকের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আমাদের জানান, রাকিব জীবনমরণের সন্ধিক্ষণে আছে। তার চিকিৎসা এখানে সম্ভব নয়। এরপর রাকিবকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলে পথে সে মারা যায়। নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী এক নারীসহ শরীফ ও তার ভাই মিন্টুকে পিটুনি দেয়। পুলিশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। এলাকাবাসী জানায়, রাকিব এর আগে শরীফের মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করতো। কিন্তু সে সেখান থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে নগরীর পিটিআই মোড়ের নাসিরের গ্যারেজে কাজ নেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শরীফ ও তার ভাই মিন্টু তাকে ‘শায়েস্তা’ করতে এ পথ বেছে নেয়। খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস জানান, শিশু রাকিবকে শরীফ মোটরসাইকেল গ্যারেজে তুলে নিয়ে গিয়ে মোটরসাইকেলের টায়ারে হাওয়া দেয়ার মেশিন তার মলদ্বারে ঢুকিয়ে পেটে হাওয়া দেয় শরীফ ও মিন্টু। একপর্যায়ে শিশু রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে রাকিব। অবস্থা গুরুতর দেখে নির্যাতনকারীরা রাকিবের শরীরের বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগ করে বাতাস বের করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। উপায়ন্তর না দেখে রাকিবকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ঢাকায় নেয়ার পথেই সে মারা যায়।
এদিকে, রাকিবকে নির্যাতনকারী গ্যারেজ মালিক শরিফ ও তার ভাই মিন্টুকে জনতার রোষানল থেকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, এ মামলায় আটক হওয়া তিনজন হলেন গ্যারেজ মালিক ওমর শরিফ, তার মা বিউটি বেগম ও মিন্টু খান।
হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ:  গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নগরীর ব্যস্ততম খানজাহান আলী রোড ও সেন্ট্রাল রোডে দফায় দফায় বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষুব্ধ খুলনাবাসী। এ সময় এ দুই সড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
রাকিব হত্যায় অভিযুক্ত নগরীর টুটপাড়ার শরীফ মোটরসাইকেল গ্যারেজের মালিক শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টুর ফাঁসি দাবি করা হয় মিছিল ও বিক্ষোভ থেকে। বিক্ষোভ মিছিলে শিশু রাকিবের একমাত্র বোন রিমি (৮) ও খালা পারুল বেগমসহ সর্বস্তরের নারী, পুরুষ ও শিশুরা অংশ নেয়।
তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা:  এদিকে সকালে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝি নির্যাতনে নিহত রাকিবের বাড়িতে এসে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এদিকে জানাজা শেষে নিহত রাকিবকে টুটপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রাকিবের বাবা আলম হাওলাদার এক ট্রাকচালকের সহকারী। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার ছিল। অভাব-অনটনের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুনের আগেই মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল সে। এদিকে রাকিবের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে তার পরিবার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তার বাবা-মা। তারা রাকিবের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.