প্রাণ দিয়ে শিশুটিকে বাঁচালেন সুমন

গত ৩ আগস্ট বনানীর সৈনিক ক্লাব লেভেলক্রসিং। রেললাইনের ওপর বসে আছে একটি শিশু। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। মা হয়তো তাকে রেললাইনের পাশে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। খেলার ছলে শিশুটি উঠে গেছে রেললাইনের ওপরে। চারদিকেই অসংখ্য মানুষ। শিশুটির প্রতি কারও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নাগরিক ব্যস্ততায় ব্যস্ত সবাই। শিশুটির প্রতি চোখ আটকালো আরেক নিম্নবিত্তের। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো লোকটির। একটু দূরেই ট্রেন। ছুটে আসছে দ্রুত গতিতে। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে শিশুটিকে রেললাইনের ওপর থেকে সরালেন ঠিকই। কিন্তু নিজে সরে আসতে পারলেন না পুরোপুরি। ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়লেন। পা’ দুটি থেঁতলে গেলো মুহূর্তেই। মাথায়ও জখম। দ্রুত সেই অচেনা লোকটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। কিন্তু অত্যধিক রক্তক্ষরণে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন তিনি। হতভাগ্য এই লোকটির নাম মোহাম্মদ সুমন (৪০)। একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের লোডার ম্যান হিসেবে কাজ করতেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা সুমনের স্ত্রী লাকী আক্তার। অসহায় হয়ে পড়লো সুমনের তিন শিশু সন্তানও। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বনানী সৈনিক ক্লাবের পাশেই ম্যাডোনা ফ্যাশনস নামে একটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে লোডার ম্যান হিসেবে কাজ করতেন সুমন। তার কাজ ছিল কাভার্ড ভ্যানে মাল তোলা আর নামানো। এজন্য প্রতিষ্ঠানের বাইরেই থাকতে হতো তাকে। পাশেই রেললাইন। কাজ না থাকলে রেললাইনের পাশেই চায়ের দোকানে সময় কাটাতেন তিনি। গতকাল বিকালেও কাজের ফাঁকে রেললাইনের কাছে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন তিনি। ঠিক তখনই শিশুটিকে রেললাইনে বসে থাকতে দেখেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন আসলেও শিশুটির তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না। আর ঝুঁকি নিয়ে কেউ শিশুটিকে সরানোর সাহসও পায়নি। কিন্তু সুমন হঠাৎ ছুটে গিয়ে ছোঁ মেরে শিশুটিকে লাইন থেকে সরিয়ে দেন। কিন্তু তিনি নিজে পুরোপুরি সরে আসতে পারেননি। চলন্ত ট্রেনের বারি খেয়ে ছিটকে পড়েন। পা থেঁতলে যায়। মাথায় আঘাত পান। পরে দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সুমনের প্রতিবেশী নায়েব নামে এক ব্যক্তি জানান, সুমন তার স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে কড়াইল বস্তিতে থাকতেন। তার স্ত্রীর নাম লাকী আক্তার। দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। বড় মেয়ে সুমির বয়স ১০ বছর। আর মেজো ছেলে রাকিবের বয়স ৫। দুই মাসের এক কন্যা সন্তানও রয়েছে তার। পরের উপকার করতে গিয়ে নিজের পরিবারকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে গেলেন তিনি। স্বজনরা জানান, সুমনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলের মাদারনগরে। বাবার নাম মৃত আবদুল কুদ্দুস। গতকাল ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ নিয়ে যান স্বজনেরা। রাত ৯টার দিকে কড়াইল বস্তিতে তার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় জানাযা শেষে লাশ দাফন করা হয়। সুমনের সহকর্মী হারুন জানান, তিনি ম্যাডোনা গার্মেন্টে লোডার ম্যানদের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। সুমন তার অধীনে কাজ করতো। নিম্নবিত্ত পরিবারের হলেও সুমন পরোপকারী মানসিকতার ছিল। অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করলো সে। তাকে হারিয়ে তার পরিবারটা অসহায় হয়ে গেলো।

No comments

Powered by Blogger.