ছাত্রলীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ শিশু: দেখলেন তবে ছুঁতে পারলেন না মা

১১ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
নিজের সন্তানকে দেখলেন নাজমা বেগম (বাঁয়ে)
পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখার আগেই শিশুটি মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। আর পৃথিবীতে আসার পর থেকেই মায়ের কোলছাড়া। অবশেষে জন্মের ১১ দিন পর গতকাল সোমবার গুলিবিদ্ধ মা নাজমা বেগম প্রথমবারের মতো দেখলেন তাঁর সন্তানকে, তাও হাসপাতালে কাচে ঘেরা ছোট্ট বেষ্টনীর বাইরে থেকে।
গুলির আঘাত, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে নাজমা বেগম প্রায় পৌনে দুই শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন গত বৃহস্পতিবার। কিন্তু যার জন্য ঢাকায় আসা, সেই সন্তানের দেখা পেলেন ঠিকই, তবে ছুঁতে পারলেন না। কাচঘেরা বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে শুধু ব্যথাভরা চোখে চেয়ে ছিলেন গুলিবিদ্ধ মেয়ের দিকে।
চিকিৎসকেরা বলছিলেন, সন্তানকে দেখলে প্রকৃতিগতভাবেই মায়ের বুকে দুধের সঞ্চার হয়। অসুস্থ হলেও তাই তারা তাঁকে সন্তানের কাছে নিতে চাইছিলেন। কিন্তু সাহস করতে পারছিলেন না শিশুটির বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া। মনে ভয় ছিল, নাজমা হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। মা-মেয়ের সাক্ষাতের কথা জানান বাচ্চু ভূঁইয়া। বলেন, সকাল ১০টার দিকে সন্তানকে দেখার সময় কেঁদেছে অঝোরে মা। তাকে দেখে আসার পর সে একরকম বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। গত ২৩ জুলাই মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম। জরুরি অস্ত্রোপচারের পর মাগুরা সদর হাসপাতালে তিনি একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। মায়ের পেটে থাকা শিশুটির পিঠে গুলি লেগে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। সংকটাপন্ন অবস্থায় গত রোববার ভোর সাড়ে চারটায় তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে মা ও মায়ের পেটে থাকা শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় গতকাল আরও দুজনকে মাগুরা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এই দুজনসহ এ মামলায় মোট ছয়জন গ্রেপ্তার হলেন।
১১ দিন পর প্রথম দেখা
চিকিৎসাধীন শিশুটির অবস্থা আরও উন্নতির দিকে বলে গতকাল জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেন, শিশুটির জন্ডিসের মাত্রা কমে আসছে। রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণও বেড়েছে। এ ছাড়া ১১ দিন পর গতকাল সকালে শিশুটির সঙ্গে তার মায়ের দেখাও হয়েছে। পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত না হওয়ায় হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে (স্ক্যাবু) শিশুটিকে রাখা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হানিফ প্রথম আলোকে জানান, শিশুটি এখন ভালোর দিকে। জন্ডিস কমে আসছে। প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। এখন প্লাটিলেট বাড়ছে। এ ছাড়া দুই ঘণ্টা পরপর বাচ্চাটিকে বিশেষ উপায়ে মায়ের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।
হাসপাতালে ইনু-শিখর: গুলিবিদ্ধ হওয়ার ১১ দিন পরে শিশুটি ও তার মা নাজমা বেগমকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখর।
শিশুটির বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সাইফুজ্জামান শিখর শিশুটিকে দেখতে আসেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বেলা একটার দিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু হাসপাতালে যান। মন্ত্রী মা ও শিশুর চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা দেন। মন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করেন, ওই ঘটনায় জড়িতরা যে-ই হোক, তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টির প্রতি নজর রাখছেন বলে শিশুটির বাবা-মাকে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে, যারা মায়ের পেটে থাকা শিশুটিকে গুলি করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এরই মধ্যে মূল হোতাকে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় হবে না, সবাইকেই ধরা হবে।’
আরও দুজন গ্রেপ্তার
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মাগুরা জেলা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকা থেকে মামলার ৭ নম্বর আসামি মো. সাগর হোসেন ও ৮ নম্বর আসামি বাপ্পীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁরা দুই ভাই। এ নিয়ে ওই ঘটনায় মামলার মোট ১৬ জন আসামির মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এর আগে গত রোববার রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে মামলার প্রধান আসামি মাগুরা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সেন সুমনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই দিনে মাগুরা থেকে মামলার ১৩ নম্বর আসামি নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে জেলা ডিবি।
ডিবি সূত্র জানায়, গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া দুজন এবং রোববার গ্রেপ্তার হওয়া সেন সুমনকে গতকাল রাতে মাগুরায় নেওয়া হয়। আজ মঙ্গলবার তাঁদের তিনজনকে মাগুরার আদালতে হাজির করা হবে।
ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার হওয়া এ মামলার অন্য দুই আসামি মো. সুমন ও মো. সুবহানকে গতকাল আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফারাহ মামুন তাঁদের এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

No comments

Powered by Blogger.