বিদেশে স্বদেশের উপলব্ধি by এম সাখাওয়াত হোসেন

বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। গিয়েছিলাম ফ্রান্স হয়ে সুইজারল্যান্ড ও উত্তর ইতালির ভেনিস নগর পর্যন্ত। এবার পিসার হেলানো টাওয়ার (Leaning Tower of Pisa) দেখার সুযোগ হলো। পিসা দেখার পর হোটেলে এসে খবর পেলাম, আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকায় পিসার টাওয়ারের চেয়ে দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে পান্থপথের মোড়ের একটি হোটেল। ভবিষ্যতে আমরাও হতে পারব অষ্টম আশ্চর্যের দেশ লিনিং হোটেল অব ঢাকা। পাঠকেরা হয়তো অবগত আছেন যে আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে যখন পিসার গির্জার বেল টাওয়ার হিসেবে তৈরি করা হয়, তখন থেকে কাজ হতে শুরু করে এবং এভাবেই প্রায় ২০০ বছরে ক্রমান্বয়ে এই সাততলা টাওয়ার তৈরি হয়। পরে বিংশ শতাব্দীতে টাওয়ারটি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে হেলে পড়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টাওয়ারটি এখন দর্শনীয় স্থান এবং টাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু স্থানে প্রতিদিন শত শত পর্যটক উঠছেন। একইভাবে হয়তো আমাদের রাজধানীর ওই হোটেল এবং হেলে পড়া জায়গা দেখতে আসবেন ভবিষ্যৎ পর্যটকেরা। ‘রাজউক’ হয়তো এমনই মনে করে।
ঢাকায় হয়তো অচিরেই আরও সুউচ্চ দালান পিসার টাওয়ারের মতো হেলে থাকবে। হয়তো কয়েকটি রানা প্লাজার মতো ধসেও পড়বে। কারণ, আমাদের দেশে ঘুষ-বাণিজ্য এবং সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকলে সবই সম্ভব। যে দেশে উচ্চপর্যায় থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত যখন কোনো জবাবদিহি নেই, সেখানে বিল্ডিং কোডই কী, আর ভবন ধসে পড়লেই কী। পান্থপথের যে জায়গায় কথিত টুইন টাওয়ার তৈরি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সে জায়গা একসময় ছিল গভীর জলাশয়। ঢাকা শহরের এরূপ বহু জলাশয় ভরাট করে সেখানে বহুতল দালান তোলা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, এ ঘটনার কারণে রাজউকের কয়েকজন মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা ঊর্ধ্বতন কাউকে পদত্যাগ করা তো দূরের কথা, কেন এমন ঘটল তার জবাবদিহি করতেও শুনিনি। উন্নত সংস্কৃতির গণতান্ত্রিক দেশ হলে হয়তো মন্ত্রি পর্যায়ের কাউকে পদত্যাগ করতে দেখা যেত।
ইতালির উত্তরের আদ্রিয়াতিক সাগরকোলের শহর ভেনিস। এই শহরটি বহু নামে পরিচিত। খালের শহর, পানির শহর এবং আদ্রিয়াতিকের রানি বলে সমধিক পরিচিত। আদি ভেনিস জলাভূমির ওপরে নির্মিত হয়েছিল বিধায় শহরের প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা খাল অথবা অত্যন্ত সরু গলিপথের মাধ্যমে। আদি ভেনিস তিন দ্বীপ নগর, যদিও বর্তমানে ভেনিস শহরের কিছু অংশ আধুনিক শহরের মতো। ভেনিস শহর কতগুলো খালের সমন্বয়ে নির্মিত, তার হিসাব সহজে পাওয়া যায় না। তবে পুরো শহরটি ১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপের ওপর তৈরি এবং প্রায় ৪০০ পায়ে চলা সেতু দিয়ে সংযুক্ত। খালগুলোতে যান্ত্রিক জলযান ব্যবহার করা হলেও পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ গন্ডোলা বা আমাদের দেশের ছিপ নৌকার মতো নৌকা। শহরটিতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার পর্যটক আসা-যাওয়া করেন। প্রতিটি খাল পূর্ণ থাকে পর্যটকে। এক অসাধারণ শহর।
ছোটবেলা থেকে এই শহরের নাম শুনছিলাম, যখন শুনতাম বরিশালকে প্রাচ্যের ভেনিস বলা হতো। খাল, বিল আর নদীর জেলা বরিশাল। শহরের মধ্যে একাধিক খাল ছিল, যার মাধ্যমে যোগাযোগ ও পণ্য বহন করা হতো শহরের মধ্যে, বাজার-ঘাটে। অনেক সময় ব্যবহৃত হতো যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও। জিলা স্কুলের সামনে, সার্কিট হাউসের সামনে এবং বর্তমান সদর রোডের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল প্রশস্ত খাল। দুই ধারে ছিল দোকানপাট আর রেস্তোরাঁ। আজ বরিশাল শহরে খাল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবই ভরাট হয়েছে কিছু অদূরদর্শী ভূমিখেকো রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে। চকবাজারের খালটি রয়েছে, তবে না থাকার মতো প্রায় ভরাট হয়ে গিয়েছে ওই খালটিও। বাল্যকালে দেখেছি, ওই খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চকবাজারে পণ্য বয়ে আনত। এখন বরিশাল শহরেও অতিবৃষ্টিতে হাঁটুপানি জমে, যা অতীতে ছিল কল্পনাতীত। আমরা কি পারতাম না বরিশালকে প্রাচ্যের ভেনিসে রূপ দিতে?
২...
আমার এই দুই সপ্তাহের সফরে প্রায় প্রতি দেশেই বহু বাংলাদেশি অভিবাসীর সঙ্গে রাস্তাঘাট, দোকান ইত্যাদিতে দেখা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দেখেছি ইতালির পর্যটন শহর ভেনিসে। দেখা হয়েছে অনেক তরুণের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে। বেশ কিছু বাংলাদেশি রয়েছেন জুরিখ শহরে। তাঁদের সিংহভাগ এখন পর্যন্ত ওই সব দেশের নাগরিকত্ব পাননি। ভেনিসে এবং অন্যান্য জায়গায় ছোট ছোট শৌখিন দ্রব্যের দোকানপাট করে তাঁদের ভাষায় ‘মোটামুটি ভালোই রয়েছে’, এমনকি পিসাতেও বহু তরুণ এ ধরনের দোকানের স্বত্বাধিকারী হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে ভেনিসে। প্রায় প্রতি রেস্তোরাঁয় তাঁরা কর্মরত। রয়েছে ছোট ছোট ব্যবসা। তবে অনেকেই ফুটপাতে ফেরি করে জীবিকা আহরণ করতে ব্যস্ত। তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ভালো অবস্থাতেই রয়েছেন। আলাপ-আলোচনার সূত্রে জানা গেল যে প্রায় সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে অবৈধ পথে ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রেক্ষাপটে আমাকে একজন বাংলাদেশি জানালেন যে শুধু রোম শহরেই তাঁর মতে ৪০ হাজার তরুণ ছোটখাটো ব্যবসা করছেন, অথচ আমাদের দূতাবাস থেকেও তাঁরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না এসব দেশে থাকার ও কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন। তবে নাগরিকত্ব পেতে আমাদের সরকারের যে ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন, তা পাচ্ছেন না। হাজার হাজার ‘ভেরিফিকেশন’ পড়ে রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক জবাবের ওপরই এঁদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
এসব দেশের সরকারের উদারতা ও মানবাধিকার আইনের আশ্রয়েই বহু বছর ধরে রয়েছেন এসব বাংলাদেশি, যাঁরা কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠাতে ভোলেন না। কত কষ্ট করে এঁরা অর্থ উপার্জন করছেন, তা না দেখলে বোঝা যায় না। আমাকে অনেকেই জানালেন যে তাঁদের উপার্জিত বহু অর্থ ওই সব দেশের আইনজীবীদের পেছনে খরচ করতে হয়, অথচ আমাদের সরকার সহযোগিতা করলে হয়তো তাঁদের এ কষ্ট লাঘব হতো। অনেকেই জানালেন, দেশে এলে তাঁদের পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেকে অহেতুক মামলা মাথায় নিয়ে বিদেশে রয়েছেন। অথচ এঁরা ওই সব দেশের বৈধ নাগরিক হতে পারলে তা দেশেরই উপকার হতো। সবাই হয়তো মারাত্মক ফৌজদারি মামলার আসামি নন।
এঁদের প্রায় সবাই দেশের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রায় শতভাগ এই শ্রেণির বাংলাদেশিরা দেশের প্রতিদিনকার খবর রাখেন। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছেন যে দেশে গিয়ে তাঁদের চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে। বিদেশে থাকেন বলে এবং বিভিন্ন অজুহাতে দেশে থাকলে প্রতিনিয়ত এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এসব কারণে দেশে ফিরতে বা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেও ভীতসন্ত্রস্ত বলে প্রায় সবারই মতামত। এঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তবু দেশে ফিরলেই হয়রানির শিকার হতে হয়। আমার মতো কাউকে পেলে তাঁদের এ বেদনার কথা প্রকাশ করেন, হয়তোবা যদি কিছু হয়?
উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সরকার এ ধরনের অভিবাসীদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে থাকে, শুধু আমাদের দেশ ছাড়া। আমাকে একজন বাংলাদেশি জানালেন যে শুধু রোম শহরেই তাঁর মতে ৪০ হাজার তরুণ ছোটখাটো ব্যবসা করছেন, অথচ আমাদের দূতাবাস থেকেও তাঁরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না। তাঁদের অনুযোগ, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সরকার ও দূতাবাস যে ধরনের সহযোগিতা করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পেতে সুবিধা হয়। ওই সব দেশের বহু অভিবাসী স্থানীয়, প্রাদেশিক ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অবস্থানের কারণে মাতৃভূমির পক্ষে স্বাগতিক দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করে থাকেন। একধরনের ‘লবি’র কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে উপমহাদেশে ভারত সবচেয়ে এগিয়ে। এরপরই পাকিস্তান। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের দূরত্বের করণে অতি মৌলিক কর্তব্যও পালন করতে পারছি না। অবশ্য বিদেশে এসব বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা না হলে হয়তো এতখানি উপলব্ধি করা যেত না।
আশা করব, আমাদের সরকার যারাই ক্ষমতায় থাকুক, এ বিষয়ে যত্নবান হবে। সরকারের মন্ত্রী মহোদয়রা বিদেশে স্বীয় দলের চাটুকারদের বাদ দিয়ে ভাগ্যাহত এসব বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের সামান্যতম সাহায্য করবেন বলে আশা রাখি। এমনকি আমাদের সাংসদেরাও বিদেশে নিজেদের সমর্থকদের বাইরে যেতে আগ্রহী নন। আশা করব, আমাদের সরকার ও নেতৃত্বে থাকা ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা এই ‘ডায়াসপোরা’ বা অভিবাসীদের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হবেন। বিদেশে তাঁদের কষ্ট লাঘবে আরও যত্নবান হবেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.