প্রাণের ফোয়ারা by জাফর আহমদ রাশেদ

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের
উদ্বোধন করেন রাশেদা কে চৌধূরী ও
আসাদুজ্জামান সুবহানী। ঢাকা, ৫ জুন ২০১৫
২৬ মে রাত সাড়ে ১০টায় যখন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের গেট দিয়ে ঢুকছি, তখন ঘুটঘুটে আঁধার। রাজশাহী বন্ধুসভার বন্ধু ফারুকের মোটরসাইকেলের আলো সঙ্গী করে মাঠে, অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে পৌঁছানো গেল। শামিয়ানা আর ত্রিপলে বাতাসের ঝাপটা লেগে পটপট শব্দ হচ্ছে। মঞ্চে মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলে একজন বলল, ঝড়ে এখন সবকিছু উড়ে না গেলে হয়!
গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা প্রতিযোগ শুরু করা যায়নি। এখন একদিকে মে মাসের প্রচণ্ড গরম, অন্যদিকে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে ঝড়ের আশঙ্কা। রাজশাহী আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে ভালোই। তবু আশঙ্কা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম হোটেলে।
রাতে বৃষ্টি হলো। সকালে (২৭ মে) হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখি, না, প্যান্ডেল উড়ে যায়নি। বৃষ্টির কারণে ভোরের তাপমাত্রা ছিল সহনীয়, কিন্তু ১০টা বাজতেই দেখি কাঠফাটা রোদ।
আমাদের একজন বলল, কী শৃঙ্খলা এবার ছেলেমেয়েদের মধ্যে! সবাই মজে আছে অনুষ্ঠানে। কোনো ছেলেমেয়েকে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাচ্ছে না। আমি বললাম, তুমি একটু হেঁটে আসো। বুঝতে পারল সে। আসলে প্যান্ডেলের বাইরে গেলেই যেন ফোসকা পড়বে গায়ে।
রংপুর ও ঢাকাতেও একই কথা। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এবার শৃঙ্খলা বেশি। হইচই, ছোটাছুটি, চিৎকার কম এবার, যদিও রাজশাহী-রংপুরে উপস্থিতি খুবই ভালো। ঢাকায় চলনসই।
রংপুর জিলা স্কুল প্রাঙ্গণটি এত বড়, ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যায়। বিরাট গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় কত পুরোনো এ বিদ্যায়তন। এখানেও ঝড়ের আশঙ্কা মিথ্যে হলো, রাতে হলো বৃষ্টি এবং সকালে (২৯ মে) বেলা বাড়তে বাড়তে বেড়েছে গরম। মঞ্চে শিক্ষকদের জন্য যেমন, তেমনি প্যান্ডেলের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল বৈদ্যুতিক পাখা। সব ঠিকঠাক। কিন্তু সাজানো দুধে পড়ল এক ফোঁটা লবণ। ঢাকা থেকে যাওয়া শিল্পী শামীমের গান যখন সবাই মন দিয়ে শুনছে, তখনই বিদ্যুৎ হাওয়া। কয়েকজন দৌড়ে গেলাম জেনারেটরের কাছে। মেশিনটা যে চালাবে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একদল গেল তাকে খুঁজতে। এর মধ্যে কে যেন নিয়ে এল ব্যাটারি। রংপুরে প্রথমআলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সাউন্ড বক্সের পাশাপাশি বুদ্ধি করে মান্ধাতা আমলের মাইকও রেখেছিলেন। তার সঙ্গে ব্যাটারি জুড়ে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। তা, গান কি আর হয়?
ঢাকায় ঘটেছে দুটো ব্যতিক্রমী ঘটনা। একটা তো নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার উপস্থিতি। সেদিন ৫ জুন, পরিবেশ দিবস। এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রান্সওঁয়া দ্য ম্যারিকো, অনুষ্ঠানস্থল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামামান সুবহানী আর দ্বিজেন শর্মা মিলে লাগালেন আমলকী গাছ। কালো জাম। দ্বিজেন শর্মা সবাইকে আহ্বান জানালেন প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে।
দ্বিজেন শর্মা ও ফ্রান্সওঁয়া দ্য ম্যারিকোর উপস্থিতিতে
লাগানো হয়েছিল গাছ। ঢাকা, ৫ জুন ২০১৫
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে মাঠের কোনায় পতাকা স্ট্যান্ডের সামনে। কঠিন রোদের মধ্যে লাইন করে দাঁড়িয়েছে ছেলেমেয়েরা। কানের পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছে ঘাম। ডান পাশে সারি সারি গাছ। উপস্থাপক সাইদুজ্জামান রওশন ছেলেমেয়েদের বললেন, লাইন ভাঙো, সবাই গাছের নিচে আসো। আমরা বরাবর ওদের লাইন করতে বলি। লাইন ভাঙার কথা এবারই প্রথম বলা হলো। সবাই দাঁড়াল এসে গাছের ছায়ায়। দ্বিজেন শর্মা যে গাছের উপকারের কথা বলেন, সে উপকার এখানে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়া গেল। সারি সারি গাছের নিচে সারি ভেঙে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার বক্তব্য দিলেন ভাষা প্রতিযোগের সহযোগী, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। ভাষা প্রতিযোগের জন্য ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজ একটা চমৎকার জায়গা। বিশাল ক্যাম্পাস। অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণকে অর্ধেক ঢেকে রাখে বিশাল বটবৃক্ষ। বটগাছের বিশাল ছাতার নিচে মঞ্চ করার পাকা ব্যবস্থা। চারদিকে আরও গাছ আরও গাছ। এই যে গাছের এত সুবিধা নিই, তার কিছুটা পরিপুরকও হবে নিশ্চয় কিছু গাছ লাগিয়ে দেওয়া। লাগিয়েছেন তাও যে সে লোক নন, স্বয়ং দ্বিজন শর্মা, যিনি নিজে নিসর্গের অংশ হয়ে উঠেছেন।
এত উদ্বেগ, এত আশঙ্কা, এত গরম—সব সয়ে এবারের ভাষা প্রতিযোগ সফল করল স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা, তাদের অভিভাবকেরা। কেউ কাছে থেকে এসেছে, কেউ কেউ এসেছে বেশ দূর থেকে। এসব ছেলেমেয়ে তীব্র গরমেও হাসিমুখ, প্রাণের ফোয়ারা।

No comments

Powered by Blogger.