তহবিল প্রশ্নে দুদকের তদন্ত চাই -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : সাঈদ খোকন by মিজানুর রহমান খান

ঢাকার নতুন দুই মেয়র পদে দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পূর্ণ হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জনবান্ধব, পরিচ্ছন্ন ও গতিশীল নগর গড়ে তোলার অঙ্গীকারের পথে তাঁরা কতটা এগোলেন, নগরবাসী কী পেল, তা জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁদের মুখোমুখি হন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো :  গত বৃহস্পতিবার আপনি নিজেই নগর ভবন থেকে কয়েক ঘণ্টায়ও বনানীর বাসায় যেতে পারেননি, পথে ইফতার সেরেছেন। এই যন্ত্রণা থেকে নগরবাসী কবে মুক্তি পাবে?
সাঈদ খোকন : যানজট ডিসিসির দায়িত্বে আসে না, আবার আসেও। ওয়াসার উচিত ডিএমপিকে সহায়তা দেওয়া। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প হিসেবে সিগন্যালিংয়ের নতুন বাতি প্রায় সর্বত্র বসে গেছে। কিন্তু জটের কারণে লাল-সবুজ-হলুদ জ্বলা-নেভার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা যাচ্ছে না। একদিন পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছিল, তাতে শহরের জট আরও বেড়ে যায়। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মৌচাক ফ্লাইওভার শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনি তো হতাশ করলেন, আশু নিস্তার নেই তাহলে? মেট্রোরেল কবে?
সাঈদ খোকন : ২০১৯-এর আগে মেট্রোরেল শুরুই করা যাবে না। তবে মহাখালী-মগবাজার ফ্লাইওভার হলে কিছুটা লাঘব হবে। শহরের দু-তিনটি পয়েন্ট খুবই ঝামেলাপূর্ণ। কাকলী থেকে শাহবাগ, ধানমন্ডি ও মিরপুর রোড। ডিএমপির সভায় আমি বলেছি, আসুন, আগে কাকলী-শাহবাগ চ্যানেলটা ঠিক করি। ইরানি রাষ্ট্রদূত বললেন, তাঁরাও নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সপ্তাহের সব দিনগুলোতে গাড়ি চলাচল করতে দেন না। গোড়াতে কাকলী-শাহবাগ সড়কে এমন একটা নিয়ন্ত্রণ চালুর কথা ভাবছি, এ জন্য একটি কমিটি করেছি।
প্রথম আলো : প্রথম ১০০ দিনে আপনার অগ্রাধিকার কী?
সাঈদ খোকন : হকার উচ্ছেদের পদক্ষেপ নিয়েছি, এ জন্য তারা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। চার-পাঁচ ঘণ্টার অভিযান চালানোর পরে দেখা গেল রাস্তাঘাট মোটামুটি পরিষ্কার, আমরা চলে যাওয়ার এক–দুই ঘণ্টার মধ্যেই আবার সাবেক অবস্থা বহাল হয়।
প্রথম আলো : তাহলে নগরবাসী মুক্ত ফুটপাত ও সড়ক পাবে না?
সাঈদ খোকন : আমরা যদি একটি সিটি পুলিশ ও সিটি কোর্ট গঠন করে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে পারি এবং স্থায়ীভাবে তদারকি করতে পারি, তাহলে এ চিত্রটা বদলানো যেতে পারে।
প্রথম আলো : সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ আপনাকে ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার’ দায়িত্বও দিয়েছে।
সাঈদ খোকন : সিটি পুলিশ যে এখনই দরকার তা নয়, একটা রিজার্ভ ফোর্স দরকার। ডিএমপি কমিশনার বলছেন, ৫০ জনের একটি ফোর্স রেখে দেব, বললেই তারা এগিয়ে যাবে। কিন্তু শিল্প পুলিশের মতো একটা সিটি ফোর্স দরকার। কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে ফুটপাত দখলদারদের সম্পর্ক থাকে, সেটা আমরা চিহ্নিত করতে পারি না। এখানে বিশাল অঙ্কের টাকা ওঠে এবং তা বিভিন্ন বিভাগে, এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের পকেটেও যায়।
প্রথম আলো : জলাবদ্ধতা দূর করতে কী করছেন, বহু এলাকায় মানুষ তো ডুবে আছে।
সাঈদ খোকন : ওয়াসার কাজ শহরের বৃষ্টির পানি সরানো। এও ঠিক নগরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। এর ওপরে বক্স কালভার্ট করে খাল ভরাট করা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের ফ্রি ফ্লাড জোন, যেখান থেকে পানি নেমে যাবে, সেখানে বালু ফেলে ভরাট করে আবাসিক প্রকল্প ও বাড়ি উঠেছে। এখানে আমরা খুবই অসহায়।
প্রথম আলো : ফুটপাত ও জলাবদ্ধতায় আপনি অসহায়, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের ব্যাপারে কী বলবেন?
সাঈদ খোকন : বৃষ্টির পরে কাজ ধরে শেষ করে দেব ইনশা আল্লাহ। অর্থাভাবে অনেক দিন কাজ বন্ধ ছিল। শুধু দক্ষিণের রাস্তাঘাটের জন্য প্রায় ৩১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। ৬ জুলাই এর প্রি-একনেক হওয়ার কথা, এরপর এটা একনেকে যাবে। অক্টোবরে কাজ শুরু করে আগামী জুন পর্যন্ত রাস্তা ও নর্দমার সংস্কারকাজ চলবে।
প্রথম আলো : আপনার তহবিল শূন্য হলো কী করে? আপনার কথায় মনে হয়, বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটেছে।
সাঈদ খোকন : হ্যাঁ। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে কয়েকটি বড় প্রকল্প, যেখানে বড় অনিয়ম ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়, তার বিস্তারিত কাগজপত্র সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চেয়েছে।
প্রথম আলো : দায়িত্ব নিয়ে কত টাকা তহবিলে দেখতে পেলেন? এই ঘাপলার জন্য দায়ী কে বা কারা?
সাঈদ খোকন : কোনো টাকা পাইনি, সাড়ে তিন শ কোটি টাকার দেনা পেয়েছি। আমার বেতন দেওয়ার পয়সা ছিল না। এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট তদন্ত হয়নি, তাই না জেনে বলা যাবে না।
প্রথম আলো : আপনি নিজে কেন একটা প্রাথমিক অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন না?
সাঈদ খোকন : মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন পেয়েছি, তাদের আমরা সেমতে তথ্য সরবরাহ করব। তহবিল কী করে খালি হলো, দুদকের অবশ্যই উচিত তদন্ত করে দেখা। আর সংসদের স্থায়ী কমিটি একটি তদন্ত করবে বলে আশা করি। সেখান থেকে কী বেরোয়, সেটা আগে দেখি।
প্রথম আলো : প্রথম ১০০ দিনের কাজ নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব?
সাঈদ খোকন : পুরো দক্ষিণে সড়কের বাতি ৬০ শতাংশের বেশি জ্বলত না। এখন সেগুলো পুনঃস্থাপনের কাজ প্রায় ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন করেছি। প্রতিটি ঘরে বিনা মূল্যে আবর্জনা ফেলার ব্যাগ পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। নগরবাসী আবর্জনা ব্যাগে ভরে রাখবেন, আমরা সংগ্রহ করব। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। জন্মসনদ অনলাইনে দেওয়া শুরু করেছি। চটপটির দোকানগুলো অস্বাস্থ্যকর।
এফএও ও আইসিডিডিআরবির সহায়তায় আমরা ৩০০ ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান (ফুড কার্ট) দেব। এর মধ্যে ১০০ বিতরণ শেষ হয়েছে। দক্ষিণে ৫৩টি পেট্রলপাম্প রয়েছে। এর প্রতিটিতে পাবলিক টয়লেট বসবে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাও স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারবেন। আইপিডিসি নামের একটি সংস্থা সৌজন্য হিসেবে একটি করে দেবে। তারা বার্তা দিতে চায় যে, সবাই মিলে যাতে এটা করি। সিএসআর হিসেবে ৫৩ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজটা ভাগ করে নিতে পারে। ডিসেম্বরের মধ্যে অর্ধেক শেষ করার আশা রাখি। খুব শক্তভাবে বাজার তদারকি শুরু করেছি। দক্ষিণে ২১টি বাজার আছে। দাম ওঠানামা করবে। কিন্তু পাইকারি হারের সঙ্গে খুচরা বাজারের সংগতি থাকতে হবে। এ জন্য আমরা চার্ট টানানোর নিয়ম করেছি।
প্রথম আলো : দীর্ঘ মেয়াদে কী করবেন?
সাঈদ খোকন : বুড়িগঙ্গার ব্যাপারে অনেক বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এর ড্রেজিং ও পরিচ্ছন্ন করার দায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। আমি তীরে কিছু করার কথা ভাবছি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক দ্রুত সই হবে। দক্ষিণের এলাকা বাড়িয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারেও বিস্তৃত করা হবে।
প্রথম আলো : নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসেছেন?
সাঈদ খোকন : এখনো নয়। তাঁর একটা গাইডলাইন ছিল, কাজ কিছুটা বুঝে নিয়ে বসা, যাতে আলোচনাটা ফলপ্রসূ হয়।
প্রথম আলো : উত্তরের মেয়রের মতে সেখানে কমিশনারদের মধ্যে প্রায় ১৫ বিদ্রোহী আওয়ামী লীগার, বিএনপির ৩ ও জামায়াতের ২ মহিলা কাউন্সিলর আছেন। এটা দক্ষিণের অবস্থা কী?
সাঈদ খোকন : আমার ৫৭ কমিশনারের মধ্যে বিদ্রোহী সংখ্যা ১৫-এর বেশি, বিএনপিরও প্রায় ৮ জন আছেন। সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক। আর শিগগিরই আমি ঢাকা সংলাপের উদ্যোগ নিচ্ছি।
প্রথম আলো : আপনার আড়ম্বরপূর্ণ যাতায়াতে যানজট আরও বাড়ে, ভেঁপু বাজে। আনিস সাহেব বললেন, তিনি গাড়ি থেকে সাইরেন খুলে ফেলেছেন। আপনি হানিফ ফ্লাইওভারে টোল দেন না। টোল চাওয়ার ঘটনায় এক কর্মকর্তার নাকি বদলি ঘটেছে। এসব সত্যি?
সাঈদ খোকন : (হাসি) না। চলতে গেলে বিধিমাফিক তিনটি গাড়ি থাকে। আর টোল পরিশোধ করতে গিয়ে আমার সেদিন দ্রুত পৌঁছানোয় বিলম্ব ঘটছিল। আমাদের কনভয়ের পাঁচ-সাতটি গাড়ির টোল একসঙ্গে দেওয়া নিয়ে কর্মীদের সঙ্গে একটু বচসা হয়েছিল, এরপর প্রকল্পের পিডি আমার অজ্ঞাতসারে আমার টোলমুক্ত চলাচলে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। আমি জানামাত্র তা প্রত্যাহার করিয়েছি। আমি টোল দিয়েই চলছি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাঈদ খোকন : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.