দৃশ্যমান মার্কিন নরনারী by উম্মে মুসলিমা

মার্কিন মুল্লুকে এই প্রথম। যে দেশেই যাই, সেখানকার প্রকৃতি ও স্থাপনা অপেক্ষা অধিবাসীদের চালচলন, আচার-আচরণ লক্ষ করা আমার একধরনের নেশা। কোনো প্রকৃত মার্কিন পরিবারে ঢুকে ভেতর থেকে তা দেখার সুযোগ হয়নি। আমার যা দেখা, তা দৃশ্যমান নারী-পুরুষ। দীর্ঘদিনের অভিবাসী বাঙালিরাও আমেরিকান। তবে গৃহাভ্যন্তরে তাঁরা অনেকেই বাঙালিত্ব ধরে রেখেছেন। খাওয়াদাওয়া, অতিথি আপ্যায়নে বাঙালিরা তাঁদের স্বভাবে অটুট। তবে যেহেতু আমেরিকার আইন প্রায় শতভাগই নারীবান্ধব, সেহেতু বাঙালি নারীরাও সময়ে-দুঃসময়ে ৯১১ ডাকার ব্যাপারে বেশ সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তবে রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে বাঙালি মুসলমান নারীদের হিজাব পরার যে ঢল, তা নাকি বেশ আগে এ রকম ছিল না। তাতে তাঁদের কাজ বা হাঁটাচলায় কোনো বিঘ্ন ঘটাচ্ছে না। কেবল চিনতে সাহায্য করছে যে এঁরা মুসলমান।
যাঁরা পশ্চিমা ধাঁচের কাপড় পরছেন, তাঁদের আবার অনেক সময় স্প্যানিশদের থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। চেহারার এহেন মিল দেখে একজন বলছিলেন, আচ্ছা, বাঙালিদের আদি নারী-পুরুষ কি স্প্যানিশ ছিলেন? তবে আমার চোখে আমেরিকার বিস্ময় বিশালাকৃতির দালানকোঠা নয়, বরং বিশালাকৃতির লোকজন। উইকিপিডিয়ার বরাতে স্থূলাকৃতি মানুষদের দেশ হিসেবে আমেরিকা পৃথিবীর ১ নম্বর। এ দেশে প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন স্থূল বিবেচিত হচ্ছেন। জরিপে জানা যায়, আর্থিক সচ্ছলতা ও ব্যায়ামহীনতাই নাকি এর কারণ। এমন স্থূলাকৃতি মানুষ বাংলাদেশে একটাও চোখে পড়েনি। স্থূলত্ব যেমন স্থূলাকৃতি মানুষের নিজের জন্য সমস্যা, তেমনি এটা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সামাজিক সমস্যার একটি।
ওঁদের একটা বিষয় বেশ ভালো লাগার। বয়স্ক দম্পতি বা সঙ্গীরা সেজেগুজে রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে একে অন্যের হাত, কোমর বা ঘাড় ধরে চলাফেরা করেন। কখনোই তাঁদের বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখা যায় না। এটা দৃষ্টিকটু তো লাগেই না, বরং একে অন্যকে না ছুঁয়ে থাকলেই তা যেন অপরিশীলিত বলে মনে হয়।
ওঁরা স্বাধীনতাকে ইচ্ছেমতো উপভোগ করেন। স্বাধীনতা যেন একপ্রকার মানবাধিকার। ট্রেনে, বাসে, পার্কে, রাস্তায় যুবক-যুবতীদের কেউ কেউ আলিঙ্গনবদ্ধ, চুম্বনরত। সাধারণতই তাঁদের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। যেদিকে ইচ্ছে, সেদিকে তাকানো মানবাধিকার হলেও ভব্যাধিকার নয়। আমরা যারা নতুন ভ্রমণকারী, তারা আড়চোখে না দেখার ভান করে দেখে নিই। অস্বস্তি লাগে। আমরা শিখেছি স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতা নয়। একে তাহলে কী বলব? একে ইংরেজিতে বলা হয় ‘পাবলিক ডিসপ্লে অব অ্যাফেকশন’ বা সংক্ষেপে পিডিএ। বাংলায় ‘জনসমক্ষে ভালোবাসা প্রদর্শন’ বলা যেতে পারে।
পিডিএ নিয়ে মার্কিন মুল্লুকেও বিতর্ক আছে। স্কুলে ক্লাসের বাইরে পিডিএ একেবারে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে মত দেন ২১ শতাংশ, ৭৯ শতাংশ মানুষ ভাবেন পিডিএ থাকা উচিত নীতি অনুযায়ী বাসযোগে নায়াগ্রা দর্শনে যাচ্ছিলাম নিউইয়র্ক থেকে। সামনের সিটে এক জোড়া তরুণ-তরুণী টানা আট ঘণ্টার ভ্রমণে ১৫-২০ মিনিট পরপর যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে যাচ্ছিলেন। দুই সিটের ফাঁক দিয়ে তা নজরে পড়াই স্বাভাবিক। শেষমেশ ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। তাঁদের পাশের সিটে সাত-আট বছরের ছেলে নিয়ে এক দম্পতি। আমাদের নিজেদের জন্য যতটা না, শিশুটির জন্য তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি লাগছিল। জানি না ওখানকার শিশুরা বিষয়টি কীভাবে নেয়। হয়তো কিছুই ভাবে না। আমরা নিজেদের দেশে ঘরে শিশুদের নিয়ে কোনো ইংরেজি মুভি দেখতে বসলে মুভির অন্তরঙ্গ দৃশ্য আসার আলামত দেখেই চ্যানেল পরিবর্তন করে দিই। শিশুদের শৈশব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী কতই না গবেষণা। শিশুতোষ বই, কার্টুন, সিনেমা, পার্ক, গেম, টিভি শো ইত্যাদি নিয়ে নতুন নতুন ভাবনায় শিল্পী-সাহিত্যিকেরা পরিশ্রম করছেন।
পিডিএ নিয়ে মার্কিন মুল্লুকেও বিতর্ক আছে। স্কুলে ক্লাসের বাইরে পিডিএ একেবারে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে মত দেন ২১ শতাংশ, ৭৯ শতাংশ মানুষ ভাবেন পিডিএ থাকা উচিত নীতি অনুযায়ী—মানুষের বিরক্তি উৎপাদন না করে সীমিত পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য অনুরাগ প্রদর্শনে বাধা নেই। কিন্তু কে আর মানছে তা? কেবল বিপরীত লিঙ্গের মধ্যেই এসব সংঘটিত হচ্ছে না। সমলিঙ্গের জুটিও কোনো অংশে কম যান না। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার সামনেই বিরক্তিকর ভালোবাসা প্রকাশ করতে যেন তাঁরা বদ্ধপরিকর। এমনও দেখা গেছে, কেউ তাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে যেন তাঁরা আরও মরিয়া হয়ে ওঠেন। শিশু-কিশোরদের ওপর এর প্রভাব কোনোভাবেই তুচ্ছ করার নয়। কিশোরীদের মধ্যে এক বিরাট অংশের গর্ভধারণের এটা একটা অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ও দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর এক মিলিয়ন করে কিশোরী অনভিপ্রেত গর্ভধারণ করছে।
অনেকে বলবেন, ততটা আধুনিক নই বলেই এগুলোকে বাঁকা চোখে দেখছি। ওদের অসুবিধা না হলে আমার কী? এ শুধু আমারই দুশ্চিন্তা নয়, ও দেশে যতজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁদের মতামত নিয়ে জানা গেছে, তাঁরাও বয়স্ক এবং বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে চলাফেরায় স্বস্তিবোধ করেন না। অনেকে কেবল এই একটিমাত্র কারণেই বাচ্চাদের নিয়ে দেশে ফিরে আসার কথা ভাবেন। ইন্টারনেটের বদৌলতে এ বিষয়ে খোদ আমেরিকানদেরও মন্তব্য জানা যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, ওখানকার শতকরা ৭৯ ভাগ লোক মনে করেন, পিডিএ কোনোক্রমেই যথেচ্ছাচার হওয়া উচিত নয়।
সভ্য দেশ হিসেবে নিজেদের জাহির করতে যুক্তরাষ্ট্রের তো জুড়ি নেই। একটা শিক্ষিত, মর্যাদাবোধসম্পন্ন, পরিশীলিত পরিবারের লোকজন যেমন বাড়ির মধ্যেও উচ্চ স্বরে কথা বলেন না, উচ্চ আওয়াজে গান শোনেন না বা করেন না, বাড়ির বাইরে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করেন না, সেখানে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের অপ্রতিরোধ্য দৃশ্যায়ন—যা কিনা মানুষকে যুগপৎ হয়রানি ও বিরক্ত করে, তা কী করে সভ্য সমাজের উদাহরণ হয়? কেবল পাবলিক নুইসেন্সের কথা মাথায় রেখে যে দেশে খুব জরুরি ছাড়া কেউ গাড়ির হর্ন বাজান না, অনুমতি ব্যতিরেকে রাত ১০টার পর কেউ টেলিফোন করেন না, কিউ ভাঙার কথা কেউ কল্পনাও করেন না, ময়লা ফেলার ঝুড়ি ছাড়া যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলেন না, রেস্টুরেন্টে উচ্চ স্বরে ওয়েটারকে ডাকেন না, তাঁরা কী করে বেশির ভাগ জনগণের বিরক্তিকে উপেক্ষা করে পিডিএর স্বাধীনতা ভোগ করার মতো দুর্বিনীত হন?
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
muslima.umme@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.